ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে ইরান। দেশটির এ হামলায় ড্রোনসহ বিভিন্ন ধরনের আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। ইরানের হামলায় তেল আবিব ও পশ্চিম জেরুজালেমসহ ইসরায়েলি শহরগুলোতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের ৭২০টির বেশি জায়গায় বিমান হামলার সাইরেন বেজে উঠেছে। রোববার (১৪ এপ্রিল) কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
ইরানের হামলার পরপর ইসরায়েলি ভূখণ্ডের ভেতর ব্যাপক বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। ইরানি হামলায় সাত বছর বয়সী একটি মেয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, ইরানের ছোড়া অধিকাংশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের আকাশসীমার বাইরেই ভূপাতিত করা হয়েছে।
বাইডেন-নেতানিয়াহুর ফোনালাপ
এ হামলা পর পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনালাপ করেন বাইডেন। ফোনালাপে বাইডেন নেতানিয়াহুকে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো পাল্টা আক্রমণকে সমর্থন করবে না যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার বরাতে এই তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে অ্যাক্সিওস।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইরানের ওপর ইসরায়েল পাল্টা হামলা চালালে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। এই যুদ্ধের পরিণত ভয়াবহ হতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন বাইডেন ও তার সিনিয়র উপদেষ্টারা।
ব্যবহৃত অস্ত্র : ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, ক্রুজ মিসাইলসহ বেশ কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইরান। তাদের হামলায় ২০০টির বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগ ইসরায়েলি সীমার বাইরে প্রতিহত করা হয়েছে। তবে ইরানের এই সমন্বিত আক্রমণে একটি ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনার সামান্য ক্ষতি হয়েছে।
ইসরায়েলি সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম করপোরেশন জানিয়েছে, শনিবারের হামলায় ইরান ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র, ৩০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ১৬০টি সুইসাইড ড্রোন ব্যবহার করেছে। তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, ইরানের ছোড়া অধিকাংশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের আকাশসীমার বাইরেই ভূপাতিত করা হয়েছে।
ইরানের মিশন : জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানি মিশন বলেছে, সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় এই সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিষয়টি এখানেই শেষ বলে ধরা যেতে পারে। তবে ইসরায়েলি শাসক গোষ্ঠী যদি আরেকটি ভুল করে তাহলে ইরানের জবাব আরও যথেষ্ট গুরুতর হবে। এটি ইরান ও দুর্বৃত্ত ইসরায়েলি সরকারের মধ্যে সংঘাত। এই সংঘাত থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে থাকতে হবে
নেতানিয়াহুর প্রতিক্রিয়া : ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, বিগত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তহে ইরানের সরাসরি আক্রমণের বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে ইসরায়েল। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়েছে। আমরা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত— সেটা হতে পারে প্রতিরক্ষামূলক বা আক্রমণাত্মক।
তিনি বলেন, আমরা ইসরায়েলের পাশে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অন্যান্য অনেক দেশের সমর্থনের প্রশংসা করি। আমরা একটি স্পষ্ট নীতি নির্ধারণ করেছি : যারা আমাদের ক্ষতি করবে, আমরা তাদের ক্ষতি করব। আমরা যেকোনো হুমকির বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করব।
বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া
জো বাইডেন : মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের হামলার হালনাগাদ তথ্যের জন্য আমি আমার জাতীয় নিরাপত্তা দলের সাথে দেখা করেছি। ইরান ও এর প্রক্সিদের হুমকি মোকাবিলা ও ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি ইস্পাত-দৃঢ়।
আন্তোনিও গুতেরেস : জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, আমি ইসরায়েলের ওপর ইরানের বড় ধরনের আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানাই। আমি এই ধরনের শত্রুতা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানাই।
তিনি বলেন, আমি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন একটি ধ্বংসাত্মক উত্তেজনার সত্যিকারের বিপদ সম্পর্কে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক ফ্রন্টে বড় সামরিক সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ এড়াতে আমি সবাইকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানাই।
ঋষি সুনাক : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, আমি ইসরায়েলে ইরানের বেপরোয়া আক্রমণের কড়া ভাষায় নিন্দা জানাই। এই হামলা এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি তৈরি করে। ইরান আবারও প্রমাণ করল যে নিজের উঠোনে অশান্তির বীজ রোপনের ইচ্ছা রয়েছে তাদের।
তিনি বলেন, ইসরায়েল এবং জর্ডান ও ইরাকসহ আমাদের সব আঞ্চলিক অংশীদারদের নিরাপত্তা জন্য যুক্তরাজ্য তাদের পাশে দাঁড়ানো অব্যাহত রাখবে। আমাদের মিত্রদের পাশাপাশি আমরা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে এবং উত্তেজনা রোধে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করছি। কেউ আর রক্তপাত দেখতে চায় না।
জোসেপ বোরেল : ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের অগ্রহণযোগ্য হামলার তীব্র নিন্দা জানায় ইইউ। এটি নজিরবিহীন উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।
ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি
আইডিএফ জানায়, শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করে ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হামলা প্রতিহত করেছে তারা। ইসরায়েলি ভূখণ্ড অতিক্রম করার আগেই এই অঞ্চলের কৌশলগত মিত্রদের সঙ্গে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অ্যারো ব্যবহার করে তারা হামলা প্রতিহত করেছে বলেও দাবি করে ইসরায়েলের এই বাহিনী।
তবে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে একটি ঘাঁটিতে কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আঘাত হেনেছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ। এতে সামান্য অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করে এই বাহিনী।
আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, ইরানের হামলায় একজন আহত হওয়ার খবর জেনেছেন তারা। তিনি বলেন, ইরানের বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে আঘাত হানার পরে একটি সামরিক ঘাঁটিতে সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে কোন ঘাঁটিতে কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে, তা জানানো হয়নি।
হামলায় কে আহত হয়েছেন, তা নিয়ে হাগারি বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে এর আগে ইসরায়েলের অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবার পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্যারামেডিক সাত বছরের এক মেয়েকে চিকিৎসা দিয়েছে। আরাদ অঞ্চলে বেদুইন অধ্যুষিত এলাকায় গোলার আঘাতে মেয়েটি আহত হয়েছে।
উল্লেখ্য, শনিবার রাতে অপারেশন ট্রু প্রোমিজ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে ইরান। এ প্রতিক্রিয়া সীমিত ও নির্ধারিত হবে বলে জানিয়েছেন ইরানের কর্মকর্তারা। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান কী করতে সক্ষম তার সামান্য চিত্র দেখাল মাত্র। এটা এমন একটি দৃশ্য যা কখনো কেউ দেখেনি।
এমন হামলার পরেই পাল্টা হামলার আশঙ্কায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী, একই সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতিও সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া বিবৃতিতে আইআরজিসির এক কমান্ডার জানান, ইসরায়েল যদি প্রতিক্রিয়া দেখায় তাহলে তার চেয়েও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাবে ইরান।