ভারত মহাসাগরে গত ১২ মার্চ জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুরা জাহাজে উঠে প্রথমে নাবিকদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এরপর জাহাজটিকে সোমালিয়ার উপকূলে দস্যুদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় নিয়ে যেতে বাধ্য করে। একপর্যায়ে সুবিধাজনক স্থানে জাহাজটিকে নোঙর করায় দস্যুরা। এরপর মুক্তিপণের বিষয়ে দেনদরবার শুরু হয়।
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমঝোতা করতে কাজ শুরু করে। যদিও মাঝখানে দস্যুমুক্ত করতে জাহাজে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিল বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী। তবে নাবিকদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকায় এতে রাজি ছিল না জাহাজের মালিক পক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকার। তারা শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে জাহাজকে মুক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
জাহাজ উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় নিশ্চিত হয় ঢাকা পোস্ট। তারা বলেন, সোমালিয়ান দস্যুদের বেশিরভাগই ইংরেজি ভাষা জানে না। ফলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তবে দস্যুদের একজন কমান্ডার ছিল, তার সহকারী মোটামুটি ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ করতে পারতেন। তার মাধ্যমে যোগাযোগটা শুরু হয়। এরপর নাবিকদের সার্বিক বিষয়ে তদারকি করত মালিক পক্ষ। শুরুতে দস্যুরা নাবিকদের বিষয়ে একটু কড়াকড়ি করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দস্যুরা স্বাভাবিক আচরণ করে। দর কষাকষি শেষে ঈদের আগে দস্যুদের সঙ্গে মুক্তিপণের কত হবে সেটি চূড়ান্ত হয়।
কিন্তু এসব টাকা কীভাবে পৌঁছানো হবে সেটি নিয়ে বিপত্তি বাঁধে। এক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতা কাজ লাগায় জাহাজের মালিক পক্ষ। সিদ্ধান্ত হয় বিমানে পাঠানো হবে মুক্তিপণ। অপেক্ষাকৃত ছোট যেসব বিমান মোটামুটি নিচে চলাচল করতে পারে এ রকম একটি বিমানে করে মুক্তিপণের ডলার নিয়ে এমভি আবদুল্লাহর কাছে পৌঁছে যায় বিমান। বাংলাদেশ সময় শনিবার (১৩ এপ্রিল) বিকেলে বিমান থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় জাহাজের ২৩ নাবিক সুস্থ আছেন। ওই সময় জাহাজের উপরে লাইন ধরে দাঁড় করানো হয় নাবিকদের। এরপর জাহাজ থেকে ডলারভর্তি ৩টি ব্যাগ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সেগুলো স্পিডবোট দিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে জাহাজে উঠে দস্যুরা। এ সময় দাবি অনুযায়ী ডলার আছে কি না সেটিও নিশ্চিত হয়ে নেয় দস্যুরা।
জিম্মি জাহাজের মালিক পক্ষ কেএসআরমের গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, আমরা জানতাম নাবিকরা ভালো আছেন। তারপরও সর্বশেষ গত দুদিন আগে আমাদের শেষ রিকোয়ারমেন্ট ছিল নাবিকরা কেমন আছেন সেটা জানা? এ জন্য প্রত্যেক নাবিকের স্বতন্ত্র ভিডিও আমরা নিয়েছি। সেটি তারা আমাকে পাঠিয়েছে। এরপর আমরা ওদের প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে শুরু হয়। সবকিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রে আমরা আমেরিকার নিয়ম মেনেছি, কোন ক্ষেত্রে ইউকে আবার কোনো ক্ষেত্রে সোমালিয়ার নিয়ম মেনেছি।
তিনি বলেন, সফল আলোচনা ও সমঝোতা শেষে দস্যুরা আমাদের জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শনিবার রাত ৩টার দিকে আমার কাছে জাহাজের ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে প্রথম মেসেজ আসে। তখন দস্যুরা মোট ৬৫ জন ছিল। তারা মোট ৯টি বোটে করে জাহাজ থেকে নেমে চলে যায়। এরপর জাহাজের স্পিকারে ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন জাহাজের ভেতরে কান্নার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আগামী রোববার (২০ এপ্রিল) জাহাজ দুবাই বন্দরে পৌঁছাবে। আমরা আগামীকাল (সোমবার) নাবিকদের সঙ্গে কথা বলব। তারা জাহাজে ফিরবে নাকি বিমানে করে দেশে ফিরবে, সে বিষয়ে তাদের মতামত নেব। তাদের মতামত পাওয়ার পরই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।
তবে কত টাকা মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে সেটির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি মেহেরুল করিম। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কথা না বলতে চুক্তি হয়েছে।
জানা গেছে, ৫৮ হাজার টন কয়লা নিয়ে গত ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে এমভি আবদুল্লাহ। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল।
কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এ রকম মোট ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।