আমার কুলে পুলাডা ছটফটাইয়া মইরা গেল, মাথায় গুলি কইরা আমার বাপজানরে ওরা মাইরা ফেলাইছে। বাঁচবার লাইগা আমার বাপজান আমার কাছে কতই না আকুতি করছে। কিন্তু আমি তো বাঁচাইতে পারলাম না। আমার পোলা তো কোনো রাজনীতি করতো না। তারপরেও আমার নিরপরাধ পুলাডারে এভাবে মাইরা ফেলাইলো। আল্লাহ এর বিচার করবো।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া গার্মেন্টস কর্মী আসিফের বাবা আমজাদ হোসেন কাঁদতে কাঁদতে কালবেলাকে কথাগুলো বলছিলেন।
আসিফ শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কেরেঙ্গাপাড়া গ্রামের ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেনের ছেলে। ১৯ জুলাই সন্ধ্যা ছয়টার দিকে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাত ৯টার দিকে তার মৃত্যু হয়। ২০ জুলাই সকালে তার মরদেহ শেরপুরে আনা হয় এবং দুপুরে সামাজিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
রোববার (২৮ জুলাই) সকালে আসিফদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা কবরের পাশে বসে কাঁদছেন। বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখা যায় তার মা ফজিলা খাতুন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আসেন। দুই চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরলেও মুখের কথা আটকে আসছে। এক সময় হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি।
বাড়ির সবাই মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা শুরু করলেন। মিনিট দশেক পরে স্বাভাবিক হয়ে আবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আমার পোলা তো বড় চাকরিও চাই নাই, আমার পোলাতো রাজনীতিও করে নাই। পেটের দায়ে গার্মেন্টসে চাকরি করে। তাও আমার পুলাডারে এভাবে গুলি করে মারতে হইলো কেনো। আমার কলিজার ধনরে এভাবে মাথা ফুটা করে মারতে হইলো ক্যান। যারা আমার বাপেরে মারছে আল্লাহ তাদের বিচার কইরো।’
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, আসিফের বাবা প্রায় ২০ বছর ধরে রাজধানীর ঢাকার মিরপুর এলাকায় ঝুটের ব্যবসা করেন। ব্যবসার সুবাদে অধিকাংশ সময় ঢাকাতেই থাকতেন তিনি। ছয় সন্তানসহ মোট ৮ জনের বড় সংসার তার। ৬ সন্তানের মধ্যে আসিফ দ্বিতীয়। আসিফের বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। অন্য ভাই-বোনদের নিয়ে তার মা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন।
আসিফ বছর খানেক হয় মিরপুর এলাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর থেকে তার বাবার সঙ্গে মিরপুরে বসবাস করতো। বাবার দীর্ঘদিনের ব্যবসা থাকায় অনেক মানুষের সঙ্গে তাদের সখ্য ছিল। সেই সুবাদে তৈরি হয়েছিল বন্ধু-বান্ধব। তবে অল্প বেতনের চাকরি ছেড়ে আগামী মাস থেকে বাবার ঝুটের ব্যবসায় সাহায্য করার কথা ছিল তার। প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন আসিফ। কিন্তু তা আর হলো না। এই নিষ্ঠুর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আসিফের বাবা নিজেই।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আসিফের বাবা আমজাদ হোসেন বলেন, ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ পইড়া বাসায় আসি। এরপর বাপ-পোলা মিইলা দুপুরের খাবার খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ি। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পোলাডা কইলো এক বন্ধু ফোন দিছে তার সাথে দেখা করতে হবে। শুক্রবার বন্ধের দিন, তাই পুলারে মানা করি নাই। কেরা জানে আমার পুলা আর ফিইরা আইবো না। হঠাৎ সন্ধ্যা ছয়টায় দিকে পোলায় ফোন দিয়া কইলো ‘আব্বু আমি অ্যাক্সিডেন্ট করছি, তুমি তাড়াতাড়ি আসো’।
আমি কোনমতো দৌঁড়াইয়া গিয়া দেখি মাথার ডান পাশে গুলি খাইয়া পুলাডা মিরপুরের আলোক হাসপাতালে পইড়া আছে। তহনও গোলাগুলি চলতেই আছে। রাস্তায় এডা রিকশাও নাই। যে কয়ডা আছে গুলির ভয়ে যাইবার চায় না। পরে বুঝাইয়া একটা রিকশা নিয়া সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই পুলাডারে। সেখানের ডাক্তারা মাথায় ব্যান্ডেজ কইরা রেফার কইরা দেয় নিউরোসাইন্স হাসপাতালে।
রিকশায় কইরা যখন নিউরোসাইন্স এ যাইতাছি, তখন বাপে ব্যাথায় কাতরাইয়া কইতাছিল ‘আমার উপর থেকে দাবি ছাইড়া দিও আব্বা। আমি তোমার স্বপ্নপূরণ করবার পাইলাম না। আমি আর বাঁচবো না।’তখন আমার বুকটা ফাইটা যাইতেছিল। নিউরোসায়েন্সের ডাক্তাররা কইলো আমার বুকের ধন আর নাই, মইরা গেছে।
এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ওই পরিবারের খোঁজ নেওয়া হবে। পরিবারটির সহযোগিতায় আমরা পাশে থাকব।