জনরোষের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর গা ঢাকা দিয়ে আছে দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
এমন অবস্থায় ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী কেন্দ্র করে ঢাকায় শোক ও শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের কর্মসূচিতে নিরাপত্তা দিতে নতুন সরকারকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিবিসি বাংলাকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শোক দিবসের অনুষ্ঠান ঘিরে নিরাপত্তার জন্য দলের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে আমি জেনেছি।’
কর্মসূচি ঘিরে আওয়ামী লীগের এই প্রস্তুতিকে স্বাভাবিকভাবে দেখছে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
এর অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শোক দিবসের আবেগকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ মাঠে নেমে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করে অপতৎপরতা চালাতে চায় বলে আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। এমন কিছুর চেষ্টা হলে আমরা বসে থাকব না।’
এরই মধ্যে ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে অনুরোধ জানিয়েছেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এত বড় একটা রাজনৈতিক দল এক সপ্তাহ পালিয়ে থাকার পর নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্যই হয়তো শোক দিবসের কর্মসূচিকে বেছে নিয়েছে।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ওইদিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যেতে চাইবে। অন্যপক্ষও সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করবে। এতে হয়তো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি অডিও কলে দলীয় নেতাকর্মীদের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে যাওয়ার নির্দেশনা দিতে শোনা যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে। তবে এই অডিও কলটি ভ্যারিফাই করা যায়নি।
শোক দিবস ঘিরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মাঠে নামা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই কর্মসূচি ঘিরে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে থাকা দলটি আসলে কী করতে চায়?
গত ৫ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেশ সক্রিয় ছিল মাঠের রাজনীতিতে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধে ওই দিন দুপুর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র অবস্থানেও দেখা গিয়েছিল।
কিন্তু শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর হঠাৎই আত্মগোপনে চলে যান দলটির নেতাকর্মীরা।
অবশ্য এর আগে, থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুরসহ, নেতাকর্মীদের বাড়িঘরেও হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া যায় বিভিন্ন জায়গায়।
সেদিনের পর থেকে গোপালগঞ্জ ও হাতে গোনা দুয়েকটি জায়গায় সারাদেশের কোথাও আওয়ামী লীগের সক্রিয় নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এমনকি শীর্ষ নেতারাও রয়েছেন আত্মগোপনে।
এমন অবস্থায় দলটি ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচি ঘিরে প্রকাশ্যে আসতে চাইছেন।
দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শোক দিবসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে দলীয় নেতাকর্মীদের শ্রদ্ধা জানাতে আসার জন্য প্রচার সম্পাদক এরই মধ্যে জানিয়েছে বলে শুনেছি।’
এই কর্মসূচিকে ঘিরে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক জেলা-উপজেলার দলীয় কর্মী-সমর্থক ও নেতাদের ঢাকায় আসতে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও দলটির কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে কথা বলে জানা গেছে।
তবে, তাদের কেউ নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘গণ বিদ্রোহের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পতন হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তো তাদের নিষিদ্ধ করা হয়নি। ১৫ আগস্ট তো শোক দিবসও আছে, সুতরাং সেই সুযোগ নিয়ে তারা হয়তো সমাবেশ করার চেষ্টা করছে।’
‘শেখ হাসিনা অডিও কলে নির্দেশ দিয়েছেন’
আগামী ১৫ আগস্ট দলীয় নেতাকর্মীদের ঢাকা এসে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে আসতে বলেছেন শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের কয়েকটি সূত্রে এমনটা জানা যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার এমন একটি অডিও কলের কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন অনেকে। ওই অডিও কলের সূত্র ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশ করেছে।
তবে স্বাধীনভাবে ওই অডিও বার্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি বিবিসি বাংলা।
একটি টেলিফোন কলে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা গেছে, ‘সবাইকে ঢাকা আসতে হবে। মৌন মিছিল করে বঙ্গবন্ধু ভবনে ফুল দিতে হবে।’
শুক্রবার স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে মোবাইল ফোনে এই নির্দেশনা দেন তিনি।
যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘নেতাকর্মী যাদের ওপর হামলা হয়েছে, যাদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, তারা যেন থানায় গিয়ে অভিযোগ (সাধারণ ডায়েরি-জিডি) করেন।’
পুলিশ কর্মক্ষেত্রে (থানায়) ফিরেছে কি না, এ বিষয়টিও তিনি ফোনালাপে জানতে চান।
গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। বর্তমানে তিনি দিল্লিতে অবস্থান করছেন।
যা বলছেন সজীব ওয়াজেদ
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এখন পর্যন্ত দুবার ফেসবুকে ভিডিও বার্তা দেন সজীব ওয়াজেদ।
রোববার রাতে সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে আগামী ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে দলীয় নেতাকর্মীদের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর অনুরোধ জানান।
যেখানে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়িটি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। জাতির পিতার সেই বাসাকে পুড়িয়ে ফেলেছে। যে বাসায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও আমাদের পরিবারকে হত্যা করা হয়।’
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসাটি ধ্বংস করা হয়েছে দাবি করে ওয়াজেদ বলেন, ‘যেই বাসা ১৯৭৫ সালের খুনিরাও ধংস করার সাহস পায়নি, যেই বাসা এতদিন মিউজিয়াম ছিল, সেই বাসাকে তারা পুড়িয়ে ফেলেছে।’
১৫ আগস্ট ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘১৫ আগস্ট আমার আহ্বান আপনাদের প্রতি, শান্তিপূর্ণভাবে ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দিয়ে আসবেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য, স্বাধীনতার চেতনার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন।’
নিরাপত্তার চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি
গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে যায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাসহ দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকে।
এমন অবস্থায় ১৫ আগস্ট ঘিরে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা নিয়ে বিবিসি বাংলা দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে।
এর মধ্যে বিবিসি বাংলার সাথে কথা হয় দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হানিফের সাথে।
হানিফ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বলে আমি জেনেছি।’
সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন, নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন।
ক্ষমতাচ্যুতরা আবার সংগঠিত হচ্ছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে হোসেন বলেন, ‘তারা লোক জড়ো করুণ আর যাই করুক, এমন কিছু করবেন না যাতে আপনাদের জীবন বিপন্ন হয়। এদেশের মানুষ এখন আর আপনাদের গ্রহণ করছে না।’
আওয়ামী লীগের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম একটি বড় দল। এ দলে অনেক ভালো মানুষ আছে, তাদের অনেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। অথচ তারা এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আপনারা দল গোছান, আপনারা তো নিষিদ্ধ না।’
সতর্ক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্র বিক্ষোভের পর ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
এর তিন দিনের মাথায় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক।
মাঠ পর্যায়ে সারাদেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম করছে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা এই সংগঠনটি।
আগামী ১৫ আগস্ট ঘিরে আওয়ামী লীগের সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সতর্ক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও।
অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দলটির কাছে থাকা বিভিন্ন অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হতে পারে বলে আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর আছে।’
সোমবার এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছে সংগঠনটির সমন্বয়করা।
আব্দুল্লাহ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিন্তু এখনো মাঠে আছে। আমরা মাঠ থেকে এখনো সরে যাইনি। ছাত্র সমাজ যে কোনো ধরনের অপচেষ্টা চালানোর প্রতিরোধ করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ওই দিন একই জায়গায় একই ধরনের কর্মসূচি পালন করে তাতে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহমদ বলছেন, ‘ছাত্ররা যদি মনে করে এটার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ আপার হ্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করছে, রাজনৈতিকভাবে যদি তারা এটা প্রতিহত করতে চায়, তাহলে হয়তো সেখানে আওয়ামী লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়বে।’
সূত্র : বিবিসি