ঠাকুরগাঁওয়ে চুরির অপবাদে দুই শিশুকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। পরে এক শিশুর বাবা-মাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাদের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের পর শিশুর মা দায়নি ঋষির মৃত্যু হয়েছে।
বুধবার (২২ মে) বেলা ১১টার দিকে শহরের জেলা পরিষদের উত্তর পাড়ার তাজুল ইসলামের লিচু গাছ থেকে দায়নি ঋষির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত দায়নি ঋষি ওই এলাকার বিষু ঋষির স্ত্রী। নিহত দায়নির স্বামী বিষু জানান, পরিষদ পাড়ার পশ্চিম এলাকার মোফাখখারুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি মঙ্গলবার (২১ মে) সকালে আমার ছেলে রাজেনকে (১১) বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। মোফাখখারুলের বাড়িতে চুরি হয়েছে বলে আমার ছেলের কাছে চুরি যাওয়া ৩ লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার দাবি করে। পরে তাকে মারধর করতে থাকে। এরপর আমাকেও ধরে নিয়ে যায়। তবে আমাকে ছেড়ে দিলেও আমার ছেলেকে ছাড়েননি তিনি। এরপর রাজেনকে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আরও মারধর করে। রাজেন একপর্যায়ে এলাকার সঞ্জিত কজুর (১৩) নামে এক ছেলে চুরি করেছে বলে জানায়। এরপর সঞ্জিতকে তারা খুঁজে বের করে। পরে দুজনকে একদল যুবকের হাতে তুলে দেন মোফাখখারুল।
রাজেন ও সঞ্জিত বলে, রকি, জনিসহ ২০-২৫ জন আমাদের শহরের গোবিন্দ নগর বড়বাড়ি এলাকায় নিয়ে গিয়ে লোহার রড, গাছের ডাল দিয়ে অনবরত পেটাতে থাকে আর বলে, ‘বল আমরা টাকা চুরি করেছি।’ শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল তাও তারা মারছিল। একপর্যায়ে ঠাকুরগাঁও রোড এলাকার একটি হোটেলে নিয়ে আমাদের খেতে দেয়। এরপর ওষুধ খাইয়ে আবার মারধর করে।
এ সময় সঞ্জিত সহ্য করতে না পেরে বলে, রাজেনের মাকে চুরির টাকা ও গয়না রাখতে দিয়েছি। এরপর রাজেনের মাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে তার ওপর পাশবিক নির্যাতন করে।
বিষুর বড় ছেলে সাজেন বলে, সকালে বাড়ি ফিরে দেখি আমার মা নেই। গাছের ডালে ঝুলছে তার মরদেহ।
পরিবারের অভিযোগ, মোফাফখারুলের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা দায়নিকে হত্যা করে গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে।
যুব মহিলা লীগের নেত্রী খতেজা বেগম বলেন, আমরা শুনেছি কিছু ছেলেরা মোফাখখারুলের সঙ্গে চুক্তি করে যে, টাকা ও স্বর্ণ বের করে দিতে পারলে তাদের একলাখ টাকা দেবেন তিনি। এই চুক্তিতে সংঘবদ্ধ ছেলেরা রাজেন ও সঞ্জিতকে মারধর করে। রাজেনের মা ও বাবার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতন ও চুরির অপবাদ সহ্য করতে না পেরে রাজেনের মা আত্মহত্যা করতে পারেন।
এ বিষয়ে মোফাখখারুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজেনের বিরুদ্ধে এলাকার অনেক মানুষের অভিযোগ আছে সে চোর। তার প্রতি আমার সন্দেহ হয়। আমি তাকে বাড়ি ডেকে আনার সময় স্থানীয়রা জড়ো হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে রাজেন ও সঞ্জিতকে গণপিটুনি দেয়। আমি পরে তাদের খাইয়ে ওষুধ কিনে দিই। চুরি যাওয়া টাকা ও স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য পরে তাদের থানায় নিয়ে যাই।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর দোলন কুমার মজুমদার বলেন, ওই শিশুরা পুলিশের কাছে বলেন, ‘স্যার আমাদের সময় দিন। আমরা বের করে দেব।’ কিন্তু ভোটের জন্য নিহত দায়নিসহ ওই শিশুকে ছেড়ে দেয়। এদিকে প্রাণের ভয়ে রাজেনের বাবা বিষু আমার বাড়িতে রাত ১২টা পর্যন্ত ছিল। এরপর ভুট্টা খেতে রাত কাটায়। সকালে গিয়ে বাড়িতে দেখে তার স্ত্রী নেই। খোঁজাঁখুজির পর দেখা যায়, বাড়ির অদূরে লিচু গাছের ডালে ঝুলছে দায়নির লাশ।
ঠাকুরগাঁও জেলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্য অ্যাডভোকেট ইন্দ্রনাথ রায় বলেন, চুরি করলেও মারধর করা যাবে না। যেহেতু এ ঘটনায় দায়নির মৃত্যু হয়েছে, এটা একটি হত্যাকাণ্ড।
ঠাকুরগাঁও থানার ওসি এবিএম ওয়াহিদ ফিরোজ বলেন, এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের পর বোঝা যাবে। তবে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।