Thursday, November 21, 2024

ছাত্রীদের বর্ণনায় ছাত্রলীগের হামলা

আরও পড়ুন

‘কোনদিকে দৌড়াচ্ছি জানি না। সবাই যেদিক যাচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছি। পেছনে একটা মেয়ে পড়ে যায়। ছাত্রলীগের ছেলেরা ওকে মাটিতে ফেলেই মারতে থাকে লাঠি দিয়ে। আমি আরও কয়েকজনের সঙ্গে কোনোমতে এসএম হলে ঢুকে যাই।’

কোটা সংস্কার ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে হলগুলোর দিকে যায়, অপর অংশ টিএসসিতেই অবস্থান করে।

এরপরই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের হাজারো নেতাকর্মী দলে দলে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান।

গতকালকের হামলায় আহত আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশ নারী শিক্ষার্থী, যারা বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। এই শিক্ষার্থীদের দাবি, ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদেরকে ‘টার্গেট করে পিটিয়েছে’।

গতকাল হামলার শিকার চার জন নারী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার।

তারা বলেছেন, বিকেল ৩টার দিকে হলগুলোর দিকে যাওয়ার পর বাণিজ্য অনুষদের দিক থেকে ছাত্রলীগের প্রায় ৫০০ কর্মী ‘রাজাকার, রাজাকার’ বলে লাঠিসোটা হাতে তেড়ে আসেন। সেখানে ছাত্ররা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেও মোটামুটিভাবে সংঘবদ্ধ ছিলেন ছাত্রীরা। তাদেরকে লক্ষ্য করেই ইট-পাটকেল ছোড়া হয়।

ছাত্রলীগের ধাওয়ায় সেখান থেকে উপাচার্য ভবনের সামনে আসেন তারা। ভিসি ভবনের সামনে থেকে ফুলার রোড হয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত রাস্তা জুড়ে দফায় দফায় তাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।

হামলার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শামসুন্নাহার হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সানজানা আফিফা বলেন, ‘অন্তত ৫০০ ছাত্রলীগ কর্মী আমাদের ধাওয়া দিলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই, যে যার মতো দৌড়াচ্ছি। কেউ টিনের ফাঁকে, কেউ বাসের ফাঁকে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদেরকে খুঁজে খুঁজে মারা হয়েছে।’

‘আমি ভিসি চত্বরে গিয়ে দেখি, সেখানে চারদিক থেকে পেটাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বাসের নিচে চাকার পেছনে লুকিয়ে থাকি। হঠাৎ দেখি চাকার নিচে অনেক ভাইয়ারাও আশ্রয় নিয়েছেন। ভাইয়াদের মারার জন্য ওরা বাসের নিচ থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে। আমি দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে বাসের ভেতরে উঠি। বাসে তখন সবাই উঠতে শুরু করেছে। ২০-৩০ জনের ঠেলাঠেলিতে একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, আমি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাব। কোনোমতে মাথা উপরের দিকে তুলে শ্বাস নিয়েছি।’

আরও পড়ুনঃ  বাবাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্যকারীদের ফেসবুকে কড়া হুঁশিয়ারি আনারকন্যার

‘তারা “রাজাকার রাজাকার” ডেকে বাসের জানালায় ইট মেরে কাঁচ ভেঙে দিয়েছে। বাসের ভেতরে অনেকে ইটের আঘাতে, কাঁচ লেগে রক্তাক্ত। বাস থেকে নামিয়ে পেটানো হচ্ছে। আমি অনুনয় করে তাদের বলেছি, “আমাদের ছেড়ে দেন। আমরা চলে যাব”।’

‘হামলার মুখে আমি কোনোমতে বাস থেকে নেমে ফুলার রোডের দিকে দৌড়াতে থাকি। দেখি কিছু মেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে, তাদের পেটানো হচ্ছে। মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে একজনের। আমাকে এসে বলছে, আপু আমাকে একটু মেডিকেলে নিয়ে যান। তাকে নিয়ে আমি মেডিকেলে যাচ্ছিলাম। একটু পর দেখি আরেকজন ছাত্র মাথা ফেটে আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। তাকে তুলে আমি নিজে রিকশা থেকে নেমে যাই। মাথা ফাটা আহত দুজনকে নিয়ে রিকশা ঢামেকের দিকে চলে যায়।’

সানজানা আফিফা যে নারী শিক্ষার্থীদের মার খেতে দেখেছেন, তার মধ্যে ছিলেন শামসুন্নাহার হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘মলচত্বরে কমপক্ষে সাতজন মেয়ে হুড়োহুড়িতে পড়ে গিয়ে এবং ছাত্রলীগের ছোড়া ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন। আহত ছেলেদের সংখ্যা আরও বেশি। সেখান থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি ফুলার রোডের দিকে চলে যাই। পুরো রাস্তাজুড়ে ছাত্রলীগ ধাওয়া দিয়েছে, ইট-পাটকেল, লাঠি-সোটা দিয়ে আঘাত করেছে। ফুলার রোডে পেছন থেকে ছোড়া ইট আমার মাথায় লাগে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। তখন ৩-৪ জন ছাত্রলীগ কর্মী এসে আমার পেটে, পায়ে একটানা লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। আমি অসহায়ের মতো মার খেতে থাকি। তখন এক সিনিয়র ভাই এসে আমাকে উদ্ধার করেন। তিনি আমাকে মেডিকেল নিয়ে যান।’

মেডিকেলে এসেও ছাত্রলীগে হামলার মুখে পড়েন এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বের হয়ে দেখি, গেটে ছাত্রলীগের লোকজন লাঠি, রড হাতে দাঁড়িয়ে আছে, হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাঁচার জন্য আমি ঢামেকের সামনে এক হোটেলে ঢুকে যাই। পরে দুজন সাংবাদিক আমাদেরকে সাহায্য করে। ওরা আমাদের সেখানে অপেক্ষা করতে বলে। পরে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সাংবাদিক দুজন নিরাপদ রাস্তা দিয়ে আমাদের হলে ফিরতে সাহায্য করে।’

আরও পড়ুনঃ  রাজধানীর জিরো পয়েন্টে ছাত্র-জনতার অবস্থান

শামসুন্নাহার হল থেকে আন্দোলনে যাওয়া কমপক্ষে ৩০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সুফিয়া কামাল হলের আবাসিক শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা।

তিনি বলেন, ‘হামলার মধ্যে আমি চশমা হারিয়ে ফেলি। পায়ের জুতাও ছিঁড়ে যায়। ফুলার রোডে তখন আমি অসহায়ের মতো দৌড়াচ্ছি। কী করব, কোনদিকে যাব—কিছুই জানি না। তখন আমাকে টার্গেট করা হলো মারার জন্য। ২০-২৫ জন ছাত্রলীগ কর্মী আমাকে ঘিরে ধরে। এক ছেলে লাঠি হাতে আমার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে বলেছে, “তোকে আমি টিভিতে দেখছি। তোর কথা শুনছি। তোকে মাইরা ফেলব।” আমাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছিল। আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদেরকে বলি “আমাকে মারবেন না প্লিজ। যেতে দেন”। আমি সেখান থেকে দৌড়াতে থাকি, তারাও আমার পেছনে লাঠি নিয়ে দৌড়াতে থাকে।’

‘ফুলার রোডে দুজন বোরকা পরিহিত পথচারী নারী আমাকে কাঁদতে দেখে তাদের পেছনে লুকিয়ে যেতে বলে। তারা আমার মাথা থেকে পতাকা খুলে ফেলতে বলে, যেন আমাকে চিনতে না পারে। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। পথচারী আরেক নারী এসে আমার মুখ চেপে ধরেন কারণ আমার কান্নার শব্দ শুনলে ওরা এসে আমাকে পেটাবে। তখনো আমি ওই দুজন নারীর পেছনে লুকিয়ে আছি।’

‘পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আমি হলে ফিরতে চেষ্টা করি। তারপর আবার ছাত্রলীগ মারতে আসে। শহীদ মিনার পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে ওরা যাকে পেয়েছে তাকেই পিটিয়েছে। ফুলার রোডে পুলিশ বক্সের সামনে আমি দেখি রাস্তায় ফেলে কয়েকজনকে পেটানো হচ্ছে। আহত হয়ে কয়েকজন রাস্তায় পড়ে আছেন, তাদের সাহায্য করারও কেউ নেই। যাকে পাচ্ছে তাকেই পেটাচ্ছে। রাস্তাজুড়ে অনেক মার খেয়েছি, শেষ পর্যন্ত কোনো মতে মেডিকেলে পৌঁছাই। আমার হাত-পা ফুলে গেছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

রোকেয়া হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী বলেন, ‘যারা আমাদের মারছিল তারা বহিরাগত, দেখে শিক্ষার্থী মনে হয় না। ভিসি চত্বরে ইটের আঘাতে আমার বান্ধবী মাথায় আঘাত পায়। তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে আমি মাথায় ব্যাগ দিয়ে ঢেকে রাখি। কোনদিকে দৌড়াচ্ছি জানি না। সবাই যেদিক যাচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছি। পেছনে একটা মেয়ে পড়ে যায়। ছাত্রলীগের ছেলেরা ওকে মাটিতে ফেলেই মারতে থাকে লাঠি দিয়ে। আমি আরও কয়েকজনের সঙ্গে কোনোমতে এসএম হলে ঢুকে যাই।’

আরও পড়ুনঃ  সুনামগঞ্জে একটি গ্রামে উচ্চস্বরে গানবাজনা নিষিদ্ধ ঘোষণা

‘এসএম হলের ভেতরে ঢুকে মেয়েরা চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে, প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছিল। একজন আপু কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলেন, তার হিজাব টেনে গলায় ফাঁসের মতো করে রেখেছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। তাকে আমরা শান্ত করার চেষ্টা করি। ছেলেদের হলের কর্মচারীদের ঘরের পেছনে আমরা চুপ করে লুকিয়ে থাকি। রক্তাক্ত কয়েকজনও সেখানে ছিল। আপুরা মুখ চেপে কাঁদছিল। কারণ কান্নার আওয়াজ বাইরে গেলে আবার মার খেতে হবে।’

‘পরে প্রভোস্ট স্যার আমাদের ভেতরের টিভি রুমে চলে যেতে বললেন। সেখানে যাওয়ার পর আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। বারবার মায়ের মুখটা ভেসে উঠছিল আর চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। সেখানে আমার চোখে মুখে পানি দিয়ে বাকিরা আমাকে শান্ত করে। মনে হলো যেন মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি।’

রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল ও সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থীরা জানান, হল থেকে যারাই গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশে গিয়েছিল, তাদের অধিকাংশই মার খেয়েছেন, কেউ কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল থেকে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন।

গতকাল বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হামলা শুরু হয়। সেখান থেকে ভিসি চত্বর, ফুলার রোড, শহীদ মিনার হয়ে ঢাকা মেডিকেলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

রাত পর্যন্ত উত্তপ্ত ছিল ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল। সেখানে হলের ভেতরে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন আর হলের বাইরে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। দুই পক্ষ নিজেদের অবস্থান থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করন। এ সময় সেখানে কয়েক দফা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দুই পক্ষের এই সংঘর্ষ রাত সাড়ে ৮টার পরও চলছিল।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ