Friday, November 22, 2024

জাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলা

আরও পড়ুন

কোটা সংস্কার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় স্লোগান দেয়ায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের জেরা ও মোবাইল ফোন চেক করার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের ৪ জন সহ অন্তত ৫ জন আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার ও এনাম মেডিকেলে প্রেরণ করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার পদত্যাগ করেছেন।

রবিবার (১৪ জুলাই) রাত ৯ টার দিকে আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের জেরা ও মোবাইল ফোন চেক করার ঘটনা ঘটে। এরই প্রেক্ষিতে হল প্রাধ্যক্ষকে এ ঘটনার জবাবদিহিতার জন্য এবং সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের জন্য দিবাগত রাত ৩টার দিকে আন্দোলনকারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হল প্রদক্ষিণ শেষে বিক্ষোভ-মিছিলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল সংলগ্ন সড়কে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধার সম্মুখীন হন তারা। ঘটনার এক পর্যায়ে হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করে বসে। ছাত্রলীগের হামলায় আন্দোলনকারীদের ৪ জন সহ অন্তত ৫ জন আহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে।

হামলার ঘটনায় আন্দোলনকারীদের মধ্যে আহসান লাবিব, সোহাগি সামিয়া, তৌহিদ সিয়াম ও মেহরাব সিফাতসহ একজন নিরাপত্তা কর্মী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে আহসান লাবিবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে সোহাগী সামিয়াকে এনাম মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

হামলার ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশী ৪৬ ব্যাচের ছাত্র প্রাচুর্য সহ বেশ কয়েকজন হামলা করছেন। এছাড়া এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. আর রাফি চৌধুরী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল্লাহর সম্পৃক্ততার বিষয়েও জানা গিয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের হলেও এমন স্লোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করেন কিছু শিক্ষার্থী। তারপর স্লোগান পুরো হলে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা সমস্বরে স্লোগান দিতে শুরু করলে ‘পলিটিক্যাল ব্লক’ থেকে কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষার্থী এসে তাদের সবাইকে ডেকে ডাইনিংয়ে আসতে বলেন। সেখানে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  বড় ভাইয়ের একদিন পর মারা গেলেন ছোট ভাইও

ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডাইনিং হলে ডেকে আনার পর শিক্ষার্থীদের স্লোগান দেওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়। এ সময় ‘শিবির’ সন্দেহে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন নিয়ে মেসেঞ্জারের মেসেজ চেক করা হয়। দীর্ঘসময় পর্যন্ত ডাইনিং হল থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পান হলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা। পরে সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে তাদেরকে স্লোগানের জন্য ক্ষমা চাইতে বলা হয়। ছাত্রলীগের নেতারা এ সময় হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদারকে সেখানে নিয়ে আসেন। প্রভোস্টের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা তার কাছে ক্ষমা চান। এরপর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরই প্রেক্ষিতে হল প্রাধ্যক্ষকে এ ঘটনার জবাবদিহিতার জন্য রাত পৌনে ১২টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ওই হলের সম্মুখে অবস্থান নেন। এসময় আন্দোলনকারীরা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিতের জন্য বারবার তাগাদা দিলেও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবরই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

পরে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হোসেন তালুকদারকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে আলোচনায় বসতে দেখা যায়।

এর কিছুক্ষণ পর রাত আড়াইটার দিকে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে পুনরায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে আসলে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাদের অগ্রসর হতে বাধা প্রদান করতে রাস্তা আটকে স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হলে শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আর রাফি চৌধুরী ও অর্থ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম তাকিদের নেতৃত্বে হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া করেন আন্দোলকারীরা। এ সময় ছাত্রলীগ কর্মীরা হলে ঢুকে গেটে তালা আটকে দেয়।

আরও পড়ুনঃ  এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দল গঠনের কোনও পরিকল্পনা নেই: নাহিদ

এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর কবিরসহ কয়েকজন শিক্ষক উভয়ই পক্ষকে থামানোর চেষ্টা করেন। তবে প্রক্টর ও শিক্ষকদের প্রচেষ্টার তোয়াক্কা না করেই ছাত্রলীগের কর্মীরা বাধা প্রদান করতেই থাকে৷ তারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘জামায়াত-শিবির’ আখ্যা দেন এবং উপস্থিত নারী শিক্ষার্থীদের অশ্লীল কথাবার্তা বলেন। এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধা অতিক্রম করে আন্দোলনকারীরা হলের সামনে গেলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা চেয়ার দিয়ে হামলা চালান।

এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হলের সকল লাইট বন্ধ করে দিয়ে ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন৷ এসময় হলের সামনে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকে৷ এসময় উপর (ছাদ) থেকে ঢিল ছোড়ার অভিযোগ-ও করেন আন্দোলনকারীরা।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হল প্রাধ্যক্ষ আন্দোলনকারীদের দমাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উস্কে দিয়ে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেন এমন অভিযোগ করলে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে শিক্ষার্থীরা এসময় তাকে ঘিরে এ ঘটনার জবাবদিহিতা চান। একপর্যায়ে ‘আমি পদত্যাগ করলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উপকার হবে’ এমন মন্তব্য করে মৌখিকভাবে তিনি পদত্যাগ করেন।

ঘটনার বিষয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগের ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল হলের সামনে বিক্ষোভ মিছিল শেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সামনে এসে উপস্থিত হই৷ এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের হল গেটে যেতে বাধা দেয়। আমরা শিক্ষকের সাথে কথা বলতে নিলে আমায় সামনে থেকে প্রথমে মাথায় ঘুষি দেয়া হয়৷ পরে আমার বুকেও আঘাত করে তারা। এতে করে আমি মাটিতে পড়ে যাই এবং আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরে আমি ক্যাম্পাস মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করি।

আরও পড়ুনঃ  পরিচয় লুকাতে খুনি লাশের দুই হাতের আঙুলের চামড়া তুলে ফেলেছিল

আরেক ভুক্তভোগী নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ৫১ ব্যাচের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিয়া বলেন, আমরা যখন হেলমেট থেকে ফিরে এসে ফাকা স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন হলের ছাদ থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। এই সময়ই একটা ইটের ভাঙা অর্ধেক অংশ আমার পায়ের উপর এসে পড়ে। পরে আমাকে মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়।

তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের অর্থ সম্পাদক ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তৌহিদুল আলম তাকিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা আমাদের হলের সামনে এসে কোটা আন্দোলনের নামে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগকে অবমাননা করে স্লোগান দিচ্ছিল। তখন আমরা একটা শান্তিপূর্ণ মিছিল নিয়ে যেতে চাইলে তারা বাধা দেন এবং গালিগালাজ করেন। তাদের ওপর কোনো হামলা করিনি, যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছি। আমরা হলে ফিরে যাওয়ার সময় তারাই আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।’

জাবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, আমরা বলেছিলাম নির্যাতন কান্ডে যারা জড়িত সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদেরকে শনাক্ত করতে। কিন্তু হল প্রভোস্ট ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সাথে মিটিং করেন। এর আগেও ধর্ষণকান্ডে জড়িতদের নিরাপত্তা দিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করে দিয়েছিলেন এই নাজমুল হোসেন তালুকদার। ভিসি ১৭ এপ্রিল আল্টিমেটাম দিলেও তার কথা তিনি রাখতে পারেন নি। প্রতিনিয়ত মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরাই এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে চললেও প্রশাসনের নেই কোনো কার্যকর হস্তক্ষেপ। আজকের এই ঘটনায় দায় প্রশাসন কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

ঘটনা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোস্তফা ফিরোজসহ প্রশাসনের পক্ষে কয়েকজন শিক্ষক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। এসময় উপ-উপাচার্য তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন এবং সকাল ১১টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ বসবেন বলে আশ্বস্ত করেন। পরে ভোর পৌনে ৫টায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ