কোটা ব্যবস্থায় ২০১০-২০১১ সেশনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন জান্নাতুন নাঈম জান্নাত নামে এক ছাত্রী। তার অভিযোগ, সাধারণ প্রার্থী হিসেবে ভর্তি পরীক্ষায় ২১৮তম হয়েও তিনি তার প্রথম পছন্দের মাইক্রোবায়োলজি পাননি। অথচ কোটার সুবিধা কাজে লাগিয়ে ৯৬২তম থেকে এক ছাত্রী ওই সাবজেক্ট পেয়েছেন।
সম্প্রতি শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ১৩ বছর আগে নিজের সঙ্গে ঘটা এমন বৈষম্যের বিস্তর বিবরণ তুলে ধরেছেন জান্নাতুন নাঈম জান্নাত। একাধিক মেরিট লিস্টের পর সাধারণ প্রার্থী হিসেবে জান্নাতের জাবিতে তৃতীয় পছন্দের প্রাণিবিদ্যা সাবজেক্ট আসে। কিন্তু ততদিনে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে ভর্তি হয়ে যান। এতে করে জবিতে ভর্তি বাতিল করে জাবিতে একই বিষয়ে পড়তে যাওয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা তখন তার ছিল না।
বৈষম্যের বিবরণ উল্লেখ করে জান্নাত লিখেছেন, ‘‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের ২০১০-২০১১ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯৬.২৫ পেয়ে মেয়েদের সিরিয়ালে ২১৮তম হয়েছিলাম। মেয়েদের জন্য ৩৭০০তম পর্যন্ত রেজাল্ট তৈরি করেছিলো। মোট সিট ছিল ২৮০টি। ২০০টি ছেলেদের আর ৮০টি মেয়েদের। ৮০টি সিটের বিপরীতে ২১৮তম, স্বাভাবিকভাবেই ১ মেরিট লিস্টে আমার নাম আসলো না। ২য় মেরিট লিস্টেও আসলো না।
ভর্তির পর প্রথম ১০ দিন ক্লাস করা না করার সাপেক্ষে জাহাঙ্গীরনগরে কিছু সিট ফাঁকা হয়। তখন আবার ডাক পেলাম। ততদিনে আমি অবশ্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যায় ক্লাসও শুরু করে দিয়েছি। যাইহোক, জাহাঙ্গীরনগরে এই অনুষদের ৬টি সাবজেক্টের মধ্যে আমার চয়েজ লিস্ট ছিল এরকম- মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাসি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োকেমেস্ট্রি, প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা। তো আমি যখন ডাক পেয়ে গেলাম জাহাঙ্গীরনগর, ২১৮তম সিরিয়ালে থেকে আমার ৪র্থ চয়েজ প্রাণিবিদ্যা আসলো।
ওখানে এই অনুষদের জন্য আরও প্রায় ৭০-৮০ জন মেয়ে স্টুডেন্ট উপস্থিত ছিল। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ৯০০ এর পরের সিরিয়ালের (সম্ভবত ৯৫২ বা ৯৬২, মনে নেই সঠিক) একজন আমার স্বপ্নের প্রথম চয়েজ মাইক্রোবায়োলজি পেয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। ১৮০০ এর পরের একজন পেয়েছে বায়োকেমেস্ট্রি, এক্সট্রা কারিকুলার কোটায় (খেলোয়াড়), ৩৫০০ সিরিয়ালের পরের অনেকেই প্রাণিবিদ্যা উদ্ভিদবিদ্যা পেয়েছে।
জগন্নাথে অনেকগুলো টাকা ভর্তি ফি দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, একই সাবজেক্ট পড়ার জন্য সেই ভর্তি ক্যান্সেল করে নতুন করে ভর্তি ফি দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর ভর্তি হওয়ার মত আর্থিক সামর্থ্য আমাদের ছিল না। জাহাঙ্গীরনগর আর পড়া হয়নি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এ’ ইউনিটে মোট সিট ছিল ১১০০ এর মতো, ঠিক মনে নেই। আমার সিরিয়াল ছিল ৯৬৬তম। পরীক্ষায় আন্সার করা সাবজেক্টের ভিত্তিতে আমি পেয়েছিলাম জীববিজ্ঞান অনুষদ। এই অনুষদের ৬টি সাবজেক্টে মোট ৪০০ টির মত সিট ছিল। এখানে আমার চয়েজ লিস্ট ছিল- মাইক্রোবায়োলজি, ফার্মাসি, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগোল, পরিবেশবিদ্যা এবং মনোবিজ্ঞান।
যেহেতু, তখন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা আলাদা ভর্তি পরীক্ষা হতো, যারা মেরিটরিয়াস ছিল তারা ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রামসহ একই সাথে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতো। তাই সিট ফিলাপের জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কেই অনেক বেশি সিরিয়াল পর্যন্ত স্টুডেন্ট ডাকতে হতো। জগন্নাথে আবার ছেলে মেয়েদের জন্য কোনো আলাদা সিট সংখ্যা ছিল না। তাই রেজাল্টও একটা লিস্টেই দিয়েছিলো। এখানে আমি প্রথম ডাকেই প্রাণিবিদ্যা পেলাম ৯৬৬ সিরিয়ালে থেকে। ১৩০০ সিরিয়ালের একজন ছেলে মাইক্রোবায়োলজি পেলো, ১৮০০ সিরিয়ালের একজন ফার্মাসি পেলো। পরবর্তীতে ৫৫০০ সিরিয়ালের অনেকেই বিভিন্ন সাবজেক্টে ভর্তি হতে পেরেছিলো, কোটা দিয়ে।
২০১৬ সালে প্রথম প্রাইমারি শিক্ষকতার চাকরি পেলাম, ৮০ এর মধ্যে ৬৮.৫০ ছিল নাম্বার। তারপরও সম্ভবত নারী কোটায় চাকরি পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে, ২০১৯ থেকে ২০২১ এর মধ্যে চাকরি পেয়েছিলাম সোনালি ব্যাংকের অফিসার ক্যাশ, জনতা ব্যাংকের অফিসার জেনারেল, রূপালী ব্যাংকের অফিসার জেনারেল এবং সর্বশেষ রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। আমার ভাগ্য আসলেই চরম ভালো ছিল যে, এই সময়ে চাকরির প্রশ্ন স্মরণকালের সেরা কঠিন ও তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। সর্বোপরি ১ম ও ২য় শ্রেণীর সকল চাকরির নিয়োগে কোটা ব্যবস্থা স্থগিত ছিল। এই হলো আমার কোটার অভিজ্ঞতা।’’
জান্নাতুন নাঈম জান্নাত বলেন, আবার বৈষম্য ফেরত আসছে। এই বৈষম্যের কষ্ট যে কতটা হৃদয়ে রক্তক্ষয়ী তা কেবল ভুক্তভোগীই জানেন। আমি একজন নারী হয়েও বলছি, নারী কোটা তুলে দেয়া হোক। শুধু প্রতিবন্ধী ও উপজাতি কোটা ব্যতীত অন্য সকল কোটাই একজন মানুষের জন্য অন্য মানুষের প্রতি বৈষম্য। স্বাধীনতার এত বছর পরও কি আমরা বৈষম্যমুক্ত হতে পারি না?