বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংযোগ দেয়া হয়েছে প্রিপেইড মিটার। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের নতুন এই সংযোজন গ্রাহকদের সুবিধার থেকে বাড়িয়েছে ভোগান্তি। গ্রাহকদের অভিযোগ, ভূতুড়ে বিল, অনুমোদনহীনভাবে কেটে নেয়া হচ্ছে চার্জ, রিচার্জ করলেও দেখা যাচ্ছে না ব্যালেন্স। এতসব কাণ্ডে প্রিপেইড মিটার যেনো ‘গলার কাঁটা’ হয়ে উঠছে। এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, প্রিপেইড মিটার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ছয় বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ গ্রাহক মোট ৪ কোটি ৭১ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৫২ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। বাকিদের ক্রমান্বয়ে এর আওতায় আনার কাজ চলছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো হলো- বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)।
ভোগান্তি কমাতে কমানোর কথা বলে চালু করা বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার এখন অনেক গ্রাহকের জন্য বড় ভোগান্তি। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ডিপিডিসির এক গ্রাহক জানান, মার্চ মাসে তার প্রিপেইড মিটারে খরচ আসে ৭শ’ টাকা। তার দাবি, একই রকম বিদ্যুত খরচ করে এপ্রিলে তার বিল ১ হাজার ২০০ টাকা আর মে মাসে খরচ দিতে হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। এছাড়া শেওড়াপাড়ার এক গ্রাহক জানান, তার প্রিপেইড মিটারে রিচার্জের সময় আগের ব্যালান্স যোগ হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের সলিমপুরের গ্রাহক মশিউর রহমান। তার একাধিক মিটারে এপ্রিল মাসের বিদুৎ বিল আসে ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৭২৮ টাকা। মে মাসে ওই বিল বেড়ে হয় ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা।
নির্দেশনা অনুযায়ী, বিতরণ পর্যায়ে গ্রাহককে ডিমান্ড চার্জ, মোট বিলের ৫ শতাংশ বিলম্ব মাশুল (বিলম্বে বিল পরিশোধ) এবং ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) অনুমোদন ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর কোনো ধরনের চার্জ বা অর্থ আরোপ করার ক্ষমতা নেই বিতরণ কোম্পানির। অথচ দেশের ছয় বিতরণ কোম্পানি এমন সব খাতে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছে, যাতে বিইআরসির অনুমোদন নেই।
এদিকে প্রিপেইড মিটারের ব্যালান্স শেষ হয়ে গেলে গ্রাহকরা জরুরি ব্যালান্স হিসেবে ২০০ টাকা নিতে পারেন। তবে এই টাকা ফেরত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে ৫০ টাকা সুদ হিসেবে দিতে হয়। অথচ বিইআরসির নির্দেশনা রয়েছে, জরুরি ব্যালান্সে কোনো সুদ নেয়া যাবে না।
বিল ছাড়ও ভোগান্তির আরেক না রিচার্জ। আগে রিচার্জ করতে ২০ ডিজিট (সংখ্যা) মিটারে প্রবেশ করাতে হতো। তবে কয়েক মাস ধরে ২২০ থেকে ২৪০টি ডিজিট মিটারে প্রবেশ করাতে হচ্ছে। এ সময় এত ডিজিট প্রবেশ করাতে গিয়ে অনেকেই ভুল করে বসছে। এতেই বাড়ছে ভোগান্তি। কয়েকবার ভুল হলে লক হয়ে যাচ্ছে মিটার। এরপর অনেক সময় ধরে বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে গ্রাহককে। মিটার আনলক করতে অনেক এলাকায় টাকা দিতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ গ্রাহকদের।
গত কয়েক দিন ঢাকার ডিপিডিসি ও ডেসকোর একাধিক আঞ্চলিক এবং অন্য জেলার থেকে বিলের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন- পোস্টপেইড মিটারে অতিরিক্ত বিল আসছে, দেরিতে বিল পাঠিয়ে জরিমানা নেয়া হচ্ছে, প্রিপেইড মিটারে রিচার্জের পর আগের ব্যালান্স যোগ হচ্ছে না, বিদ্যুৎ ব্যবহারের তুলনায় বাড়তি টাকা কাটা হচ্ছে এবং অনেক সময় ব্যালান্স দেখা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, গ্রাহককে ভালো সেবা দিতেই প্রিপেইড মিটারের ব্যবস্থা। বিদ্যুতের এই মিটারে কোনো হিডেন চার্জ নেই। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। তবে অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে চর ভবসুরে কুদ্দুস নামে এক গ্রাহকের মে মাসের বিল করা হয় ৬ জুন পর্যন্ত। বিলে সেদিন পর্যন্ত বিদ্যুতের ব্যবহার দেখানো হয় (মিটার রিডিং) ২৩৮৩৫। গ্রাহকের হাতে বিল আসার পর ১১ জুন মিটারে রিডিং দেখা যায় ২৩৬৯৪।
যশোরের চৌগাছা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহক আবদুল্লাহ আল মামুন। তার ৬ জুন পর্যন্ত মিটার রিডিং ২১৯৭০ ধরে বিল করা হয়। কিন্তু ১৯ জুন তিনি মিটারে রিডিং দেখেন ২১৯৪১। এভাবে লাখ লাখ গ্রাহকের বিল উল্টাপাল্টা হচ্ছে। যারা অভিযোগ দেন, তাদের বিল অনেক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঠিক করে দেয়া হয়। তবে অধিকাংশ গ্রাহক বিল যা আসে তাই পরিশোধ করেন। প্রতিবছর এপ্রিল-জুনে অভিযোগ বেশি আসে।
পিডিবির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, জুন ক্লোজিংয়ে আদায় বেশি দেখাতে বেশি রিডিং ধরে বিল করা হয়। পরে তা সমন্বয় করা হয়। কিন্তু বেশি ইউনিট ধরা হলে ওপরের স্ল্যাবে গিয়ে বিল বেশি আসে। এতে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ডেসকোর এক নির্বাহী পরিচালক গণমাধ্যমকে বলেন, বাড়তি টাকা নেয়ার কোন সুযোগ নেই। নিয়মের বাহিরে গিয়ে টাকা নেয়া যায় না। বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া, স্ল্যাব পুনর্বিন্যাস ও গরমে ব্যবহার বাড়ায় বিল বেশি হচ্ছে। এছাড়া আবাসিকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ৮ টাকা বিল হয়, ৪০১ ইউনিট হলে তা সাড়ে ১২ টাকার ওপরে চলে যায়। এ কারণে মাসের মাঝখান থেকে বেশি টাকা কাটা শুরু করে। নিজে মিটার কিনলেও প্রতি মাসে মিটার ভাড়া কাটে বিতরণ কোম্পানিগুলো।
এদিকে বিদ্যুত নিয়ে গ্রাহকদের এই ভোগান্তি ও অভিযোগ তদন্তে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১২ জুন বিচারপতি মো. মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারের বিল আদায় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনাসহ কয়েকটি নির্দেশনা চেয়ে গত ৬ জুন সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীর পক্ষে রিট আবেদন করেন আব্দুল্লাহ আল হাদী।
আবেদনে বলা হয়, প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটার চালু থাকা সত্ত্বেও ভোক্তাদের অতিরিক্ত চার্জ ও গোপন চার্জ দিতে হয়। বিদ্যুতের বিল আদায় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এসব বিষয় পর্যালোচনা ও সংস্কার প্রয়োজন।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে শিগগির আবার বসা হবে।