Friday, November 22, 2024

‘একদম গুলি করে দেব’, অধ্যক্ষকে পিস্তল দেখিয়ে জাপা নেতা

আরও পড়ুন

রংপুরে একটি কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার জন্য অধ্যক্ষকে গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছেন জেলা জাতীয় পার্টির (জাপা) আহ্বায়ক মো. আলাউদ্দিন মিয়া।

গত ২৪ জুন জেলার সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মফিজার রহমান মিজুর কক্ষে ঘটে এ ঘটনা। এরই মধ্যে এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে জাপার ওই নেতাকে পকেট থেকে পিস্তল বের করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি করার জন্য অধ্যক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায়।

মো. আলাউদ্দিন মিয়ার ওই পিস্তলটি ইতোমধ্যে পুলিশ উদ্ধার করেছে বলে নিশ্চিত করেছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন। নগরীর বাবু খা মহল্লায় অবস্থিত ওই জাপা নেতার বাসায় মঙ্গলবার (২ জুলাই) তল্লাশি চালিয়ে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয় বলে জানান তিনি।

এদিকে গুলি করে হত্যার হুমকির সেই দৃশ্য অধ্যক্ষের কক্ষে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়। গত ৩০ জুন রোববার রাতে সিসিটিভি ক্যামেরার ওই ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। একইসঙ্গে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।

কলেজ কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আলাউদ্দিন মিয়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপদেষ্টা ছিলেন। গত ২২ মার্চ তাকে রংপুর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে জেলা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। নগরীর বাবু খাঁ এলাকায় থাকেন তিনি। কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের দুবারের সাবেক এই ভিপি পড়াশোনা শেষে কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। এরপর অবসরে যান। সম্প্রতি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।

আরও পড়ুনঃ  একাধিক পুরুষের সঙ্গে ভিডিও ভাইরাল, কে এই তরুণী?

গত মাসের মাঝামাঝি রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের স্বাক্ষরিত একটি ডিও লেটার নেন আলাউদ্দিন। ওই ডিও লেটারসহ দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজের দুই নেতাকে সঙ্গে নিয়ে গত ২৪ জুন দুপুর ১২টার দিকে সমাজকল্যাণ বিদ্যাবীথি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মফিজার রহমান মিজুর কক্ষে যান তিনি। ৪০ মিনিট অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেন।

অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনার শুরুতে নিজেকে জাতীয় পার্টির জেলা আহ্বায়ক পরিচয় দিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, ‘রংপুরের মানুষ আমাকে ভিপি আলাউদ্দিন নামে চেনে। দলের চেয়ারম্যানের ডিও লেটার নিয়ে এসেছি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি করতে হবে। কীভাবে করতে হবে, তা আমি জানি না, জানতেও চাই না। কিন্তু আমাকেই সভাপতি করতে হবে। এই তার ডিও লেটার।’

এর জবাবে অধ্যক্ষ বলেন, ‘গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার কিছু নিয়মনীতি আছে। সেগুলো মেনেই হতে হবে। আর সভাপতি করার ক্ষমতা আমি রাখি না। ম্যানেজিং কমিটিও চাইতে হবে।’

মূলত, অধ্যক্ষের এ জবাবেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আলাউদ্দিন। সেইসঙ্গে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন তাকে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে জেলা জাতীয় পার্টির এ নেতাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি কোনো কথা শুনব না। কীভাবে করতে হবে, তা জানি না, জানতেও চাই না। যেভাবেই হোক, আমাকে সভাপতি করতে হবে। আমি ডিও লেটার নিয়ে এসেছি। এটি তোমার সামনে রাখলাম। তুমি স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করো। এখানে তোমার কোনো কথা শোনার জন্য আসিনি। আমি সেদিনও তোমাকে বলেছিলাম। এখন ডিও লেটার নিয়ে আসার মানে কিছু বুঝছো?’

আরও পড়ুনঃ  ঢাবির ক্যান্টিনে খাসির গোশতের সঙ্গে রান্না হয় দশ টাকার নোট!

আলাউদ্দিন বলতে থাকেন, ‘আমার পকেটের পিস্তলে সবসময় ছয়টা গুলি লোড করা থাকে। তোমার কি মনে হয় ইয়ার্কি করার জন্য আসছি এখানে? তুমি কোনো গুরুত্বই দিচ্ছো না। একমাত্র দাতা সদস্য হিসেবেও সভাপতি হতে পারি। এরপরও একটু অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া ভেবে আমি দলের চেয়ারম্যানের ডিও নিয়ে এসেছি। তুমি সাইন করো।’

জবাবে অধ্যক্ষ বলেন, ‘কোনো সমস্যা নেই; যদি দাতা সদস্য হয়ে থাকেন; আমি এটাতে সাইন করে দেব।’ তখন আলাউদ্দিন বলেন, ‘এরপরও বিষয়টি আমি দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডকে জানিয়েছি। সেখান থেকেও আমাকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে অধ্যক্ষ বলেন, ‘সেটি আমি জানি না। আপনি ডিও নিয়ে এসেছেন, আপনিই তা জানেন। সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না, আমাকে কিছু জানানো হয়নি।’
এমন জবাবে আরও উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান আলাউদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্যান্টের পকেট থেকে পিস্তল বের করে বলেন, ‘চুপ, ডোন্ট টক, একদম গুলি করে দেবো। কোনো কথা বলবি না। যা বলেছি, তাই কর। গুলি করে মারলে আমার লোমও বাঁকা করা যাবে না।’

এ সময় অধ্যক্ষ বলেন, ‘গুলি করে দেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সভাপতি করার ক্ষমতা আমি রাখি না।’ এদিকে পিস্তল বের করতে দেখে পাশে বসে থাকা জাতীয় ছাত্র সমাজের এক নেতা আলাউদ্দিনকে হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন। আরেক নেতা শান্ত করার চেষ্টা করেন।

আরও পড়ুনঃ  একদিন ছুটি নিলেই মিলবে ৪ দিনের ছুটি

ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ মফিজার রহমান মিজু বলেন, ‘জি এম কাদের স্বাক্ষরিত একটি ডিও লেটার নিয়ে সেদিন আমার কাছে এসেছিলেন আলাউদ্দিন। বলেছিলেন তাকে যেভাবেই হোক, কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি করতে হবে। আমি তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি কীভাবে হয়, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কিছুই শুনতে রাজি হননি।

সবশেষ বলেছিলাম, সভাপতি করার ক্ষমতা আমার হাতে নেই। এতে উত্তেজিত হয়ে পিস্তল তাক করে বলেছিলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে সভাপতি করতে হবে, না হয় আমাকে গুলি করে হত্যা করবেন। সেদিনের পুরো ঘটনার ভিডিও সিসিটিভি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে আছে। প্রায় ৪০ মিনিট তিনি আমার কক্ষে ছিলেন। অনেক হুমকি-ধমকি দিয়েছেন। আজেবাজে কথাবার্তা বলেছেন। যাওয়ার সময়ও গুলি করার হুমকি দিয়ে গেছেন।’

এ নিয়ে কথা হয় মো. আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গেও। অধ্যক্ষকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটা মিসটেক হয়ে গেছে। আসলে ভুল বোঝাবুঝি থেকে এটি হয়েছিল।’

যোগাযোগ করা হলে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এসএম ইয়াসির বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি। তবে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।’

এদিকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন বলেন, লাইসেন্সধারী পিস্তল দিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা অপরাধ। এ কারণে পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়েছে। পরবর্তীতে ভুক্তভোগী অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ