বিরোধী দলের ওপর হামলা-মামলা, নির্যাতনসহ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নানা অসংগতির দালিলিক প্রমাণ বিদেশিদের কাছে তুলে ধরবে বিএনপি। সেজন্য দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, নিবন্ধ, পর্যালোচনাসহ বিভিন্ন তথ্যের সমন্বয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে দলটি। প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার বইয়ে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের হত্যা-গুম ও নিপীড়ন, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার নানা দুর্বলতা, নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা, ভোটারদের অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের সচিত্র তথ্য সংকলন করা হয়েছে।
গুরুত্ব সহকারে সন্নিবেশিত করা হয়েছে নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের পরাজিত প্রার্থীদের ক্ষুব্ধ বক্তব্য। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, প্রভাবশালী দেশগুলোর পররাষ্ট্র দপ্তর, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে বইটি পাঠানো হবে। সেইসঙ্গে নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিয়মের বিষয়গুলো দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে বইটি নিয়ে শিগগির একটি সেমিনার আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, ইংরেজি ও বাংলায় লিখিত বইটিতে সার্বিক বিষয়বস্তুকে ১৮টি ভাগে উপস্থাপন করা হয়েছে। শুরুতে ইংরেজি ভাষায় ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট, বিএনপিসহ বেশিরভাগ দলের বয়কটের যৌক্তিকতা ও নির্বাচনের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া বিষয়ভিত্তিক প্রতিটি অধ্যায়ে সংযুক্ত ঘটনার সারসংক্ষেপ ইংরেজিতে তুলে ধরা হয়েছে। মূল অংশের শুরুতে বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কারের ২৭ দফা প্রস্তাবের ইংরেজি অনুবাদ সংযুক্ত করা হয়েছে।
বইটিতে বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা, ভয়েস অব আমেরিকা, দ্য ডিপ্লোমেট, ডয়চে ভেলে, দ্য গার্ডিয়ান, ব্লুমবার্গ, নিউইয়র্ক টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধ যুক্ত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, শাসন ব্যবস্থা ও নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতি, রেজুলেশন, বক্তব্য ও মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিপুলসংখ্যক প্রতিবেদন ও ছবি এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত পৌনে চারশর বেশি প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার বইটিতে সংযোজন করা হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে রাজপথে বছরের অধিককালব্যাপী আন্দোলন করে বিএনপি। দলটি প্রথম থেকেই বলে আসছিল, তাদের ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন দমন করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন, দমন-পীড়ন, মামলা, গ্রেপ্তার, গুম-খুনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। নির্বাচনের আগে বিদেশিদের সঙ্গে যত বৈঠক হয়েছে কিংবা যারাই বিএনপিকে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে, সবার কাছেই তারা ওই বিষয়গুলোসহ সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। তখন নিজেদের কাছে বিক্ষিপ্তভাবে থাকা তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তা তুলে ধরে বিএনপি।
নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপি বলে আসছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল একটা একতরফা, ডামি ও নিজেদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির নির্বাচন; যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক দেখাতে আওয়ামী লীগের নেতারাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় দেশবাসীকে ওই নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয় বিএনপি।
তারা এতদিন বিদেশিদের কাছে যেসব অভিযোগ করে আসছিল, বাস্তবে সেটার যে ভিত্তি আছে এবং তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একতরফা নির্বাচন বর্জন করেছে—সেটা আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরা বিএনপির উদ্দেশ্য। তা ছাড়া সরকার দেশে গণতন্ত্র রয়েছে বলে দাবি করলেও সেই গণতন্ত্রের ধরন কী, মানবাধিকার পরিস্থিতি কী—সেটা বিদেশিদের কাছে দালিলিকভাবে তুলে ধরার জন্যই বিএনপি এই বই প্রকাশ করেছে বলে দলটির নেতারা জানিয়েছেন।
তবে বিএনপির এমন উদ্যোগ প্রসঙ্গে দলের কোনো নেতাই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার কালবেলাকে বলেন, ‘বইয়ের বিষয়ে এখন পর্যন্ত আপনাকে কিছু বলতে পারব না। আগে ভালো করে জেনে নিই।’
বিগত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও ভোটের দিন কেন্দ্রীয়ভাবে তিনশ আসনের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিএনপি। নির্বাচনের পর দলীয় বিভিন্ন ফোরামে আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে নির্বাচনটি যে একেবারেই অংশগ্রহণমূলক হয়নি তার দালিলিক প্রমাণ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী বিএনপির মিডিয়া সেল এবং তথ্য ও প্রযুক্তি দপ্তরকে এ বিষয়ে একটি প্রকাশনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, তারা কিছু কিছু কাজ এগিয়েও নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো একীভূত না হয়ে বিক্ষিপ্ত আকারে ছিল। পরে শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে দলের বিশেষ একটি টিম সম্প্রতি বইটির কাজ সম্পন্ন করেছে।
জানা গেছে, নির্বাচনের নানা অনিয়ম, কারচুপি নিয়ে বই আকারে প্রকাশিত এই দালিলিক প্রমাণ নিয়ে এখন দলীয় ফোরামে আলোচনা করবে বিএনপি। সেখানে সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিগগির সেমিনারের মাধ্যমে বিষয়টি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হতে পারে। এ ছাড়া ঢাকার কার্যালয়ের মাধ্যমে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রভাবশালী দেশের কাছেও বইটি পাঠানো হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, বইটি এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে যাতে দেশি-বিদেশি মহল বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে। বইটিকে দলীয়ভাবে তথ্যভান্ডার হিসেবেও সংরক্ষণ করা হবে, যাতে পরে এটিকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। একইভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে কেউ গবেষণা করতে চাইলে বইটি সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।
বইটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে দেশের তিনশ নির্বাচনী এলাকার ৯০০ ভোটকেন্দ্রের ছবি সংযোজন করা হয়েছে। এসব ছবিতে কেন্দ্রগুলো ভোটের দিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত প্রায় ভোটারশূন্য ছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘুমিয়ে সময় অতিবাহিত করছিলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রের মাঠে ভোটারের পরিবর্তে নানা প্রাণীর বিচরণ ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি সংসদীয় আসন থেকে তিনটি করে তিনশ আসনে মোট ৯০০ ভোটকেন্দ্র বেছে নেওয়া হয়েছে।
বইটিতে বিএনপি বর্জন করায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ভোটে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে উন্মুক্ত করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেওয়া নির্দেশনাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনে আনতে বিএনপি নেতাদের কারাগার থেকে মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল—গণমাধ্যমকে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের দেওয়া এমন বক্তব্যকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভোটের পরদিন ‘নির্বাচন নিয়ন্ত্রিত ছিল, সরকারের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না’—দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের এমন প্রতিক্রিয়াকেও প্রাধান্য দিয়ে সংকলন করা হয়েছে বইটিতে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান ১৪ দলের শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এরপর ‘প্রশাসনের সরাসরি সহায়তায় ভোটে কারচুপি হয়েছে’ বলে নির্বাচনের মূল্যায়ন করেন তিনি। এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা হয়েছে। ভোটে বিজয়ী হলেও সার্বিকভাবে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে, এ কথা বলার সুযোগ নেই—জাতীয় পার্টি মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর এই বক্তব্যকেও বইটিতে গুরুত্ব দিয়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নির্বাচন হয়েছে সরকার বনাম সরকার। এমন সাজানো নির্বাচনে আর যাব না। তার এ বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে বইটিতে সংযোজিত হয়েছে।
নির্বাচনে হেরে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ বলেন, ‘অলৌকিক শক্তি কাজ করায় ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।’ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতার বক্তব্যটিও গুরুত্ব দিয়ে বইটিতে সংকলন করা হয়েছে।
এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরীফা কাদের, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ঢাবির সাবেক অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, ভারতের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্তসহ অনেকের সাক্ষাৎকার সন্নিবেশিত করা হয়েছে বইটিতে।
জানা গেছে, সেমিনারে বইটির তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের পাশাপাশি নির্বাচন এবং নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশসহ বছরব্যাপী আন্দোলনে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের নানা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে তৈরি করা ৫০ মিনিটের একটি ভিডিও ডকুমেন্টও প্রদর্শন করা হবে।