শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল মা-বাবার কোল। প্রতিদিনের মতো রোববার রাতেও বাবাকে জড়িয়ে দক্ষিণখানের টিনশেড বাসায় ঘুমিয়ে ছিল ১০ বছরের শিশু সুরাইয়া আহমেদ। তবে ঘুমের ভেতর হঠাৎ রক্তাক্ত সুরাইয়া ও তার বাবা জালাল আহমেদ। মুহূর্তে অচেতন হয়ে পড়ে শিশুটি। তার রক্তে ভিজে যাচ্ছিলেন বাবা জালালও।
সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে পাশের বহুতল ভবনের দেয়াল ধসে বাসার টিনের চালার ওপর আছড়ে পড়ে ইট-সুরকি। পরে টিনের চালা ভেঙে ভারী এসব জিনিসপত্র ঘুমন্ত জালাল ও তাঁর মেয়ের শরীরের ওপর পড়লে দু’জনই আহত হন। গুরুতর অবস্থায় দু’জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সুরাইয়া এখন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি। তার অবস্থা সংকটাপন্ন। জালাল চিকিৎসাধীন মিরপুরের একটি হাসপাতালে। তিনি জাতীয় দৈনিক সমকালের মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র নির্বাহী পদে কর্মরত।
সুরাইয়ার মা ফিরোজা হক বলেন, সকালে মেয়েকে নিয়ে আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের মতো শব্দে ঘুম ভাঙে। পাশ ফিরে দেখি ইট, বালু ও ফ্যান মেয়ের মাথায় পড়েছে। ধড়ফড় করে উঠে সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যাই। কাপড় দিয়ে মাথা ও কপাল মুছে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেয়ের শরীর। ওই অবস্থায় তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ১২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও আমার মেয়ে এখনও চোখ খোলেনি এবং নড়াচড়াও করছে না। নাক-মুখ দিয়ে শুধু রক্ত আসছে। চিকিৎসকরা বারবার বলছেন, দোয়া করেন। এর বেশি কিছুইও বলছেন না তারা। নিজের ঘরের মধ্যে ঘুমিয়েও নিরাপদ নেই আমার শিশু। এখন কোথায় যাব?
জানা গেছে, রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকায় নির্মাণাধীন বহুতল ১৪ তলা ‘সৈনিক ভবনের’ দেয়াল ধসে জালাল আহমেদের বসতঘরের ওপর পড়ে। এতে গুরুতর আহত হয়েছেন তিনি ও তাঁর মেয়ে দক্ষিণখান আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ইটের আঘাতে জালালের চারটি দাঁত ভেঙে গেছে। দুই চোয়াল ও চোখে গুরুতর জখম হয়েছে। সুরাইয়া মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছে। নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের নিবিড় পর্যাবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) সংকটাপন্ন অবস্থায় চিকিৎসা চলছে সুরাইয়ার। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে আইসিইউতে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সোমবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দক্ষিণখান গাওয়ার কাজীবাড়ি এলাকায় নির্মাণাধীন ওই বহুতল ভবনের দেয়াল ধসে তাদের ঘরের চালের ওপর পড়ে। পরে ঘটনাস্থল থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে প্রথমে উত্তরা কেসি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে জালালকে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতালে এবং তাঁর মেয়ে সুরাইয়াকে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে নেওয়া হয়।
জানা গেছে, ২৫২ নম্বর কাজীবাড়ি এলাকায় নিজস্ব দোতলা ভবনের ছাদে টিনের ছাউনি করা ঘরে পরিবারসহ বসবাস করেন জালাল। সকালে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় পাশের নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে তাদের ওপর পড়ে। এ সময় সুরাইয়ার মা ফিরোজাও তাদের পাশেই ঘুমিয়ে ছিলেন। কোনোমতে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। পাশের রুমে ঘুমিয়ে ছিল তাদের বড় মেয়ে কেসি মডেল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুবাইতা আহমেদ। সে সুস্থ আছে।
আহত জালালের বড় ভাই সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই তাদের বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু ভবন কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। গত রোববার বিকেলেও তাদের বলা হয়েছে নিরাপত্তা বেষ্টনী নিশ্চিত করার জন্য। আর তার পরদিনই সকালে দেয়াল ধসে পড়ল। এটা সন্দেহজনক। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করা হবে।
ঢাকার দক্ষিণখান থানার ওসি শেখ আমিনুল বাশার বলেন, খবর পাওয়ার পরপরই পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ভুক্তভোগীর পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলেই মামলা নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া আহতদের খোঁজখবর রাখছে দক্ষিণখান থানা পুলিশ।
এর আগে মোহাম্মদপুরে পৃথক দুটি নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক যুবক ও এক নারী নিহত হয়েছেন। যুবক নিহতের ঘটনায় ৫৫ জনের নাম উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন তার স্বজনরা। কিন্তু নারীর মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। এদিকে, মালিবাগ মোড়ে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাথায় ইট পড়ে এক ব্যাংক কর্মকর্তা মারা যান। ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত রহস্য উদ্ঘাটনই করতে পারেনি পুলিশ।