ইরানে ইসলাম রক্ষার নামে বেশ সরব দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। এবার তাদেরই বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার দোহাই দিয়ে গ্রেপ্তার এক কিশোরীকে যৌন নির্যাতনের পর হত্যা করেছে তারা।
দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর ফাঁস হওয়া নথি পর্যালোচনা এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের পর মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বিবিসি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে এ বিষয়ে বিবিসির যোগাযোগের পরও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি ইরান।
হত্যার শিকার নিকা শাকারামি (১৬) এক বিক্ষোভের পর নিখোঁজ হন। এক সপ্তাহের বেশি সময় পর মর্গে তার লাশ শনাক্ত করে পরিবার। সে সময় ইরান সরকারের পক্ষে দাবি করা হয়, বিক্ষোভের সঙ্গে নিকার মৃত্যুর ঘটনায় যোগসূত্র নেই। সে আত্মহত্যা করেছে।
কিন্তু নিকার সঙ্গে ঘটেছে এক ভয়াবহ ঘটনা। তাকে গ্রেপ্তারের পর যৌন নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর তিন সদস্য জড়িত। তারা হলেন- আরশ কালহর, সাদেগ মনজাজি ও বেহরুজ সাদেগি। আর ওই দলের নেতা ছিলেন মোর্তেজা জলিল। তিনি মূলত তথ্য গোপন করতে সহায়তা করেন।
এ সংক্রান্ত একটি শুনানি করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)। তারা দেশটিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত রাখতে বিভিন্ন দমনমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত।
সেই শুনানিতে জড়িতদের নাম এবং যেসব উচ্চপদস্থ কমান্ডার ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছেন তাদের নাম রয়েছে। এ নথি ফাঁস হয়েছে।
যেভাবে গ্রেপ্তার হয় সেই ইরানি কিশোরী
২০২২ সালে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে নিখোঁজ হন নিকা শাকারামি। বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার সময় তার একটি ভিডিও পাওয়া গেছে।
সেখানে দেখা গেছে, তেহরানের লালেহ পার্ক এলাকায় সে একটি ডাস্টবিনের ওপর দাঁড়িয়ে হিজাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাকে ঘিরে বিক্ষোভকারীরা স্লোগান দিচ্ছেন। তাকে আয়াতুল্লা আলী খামেনিকে একনায়ক উল্লেখ করা হচ্ছিল। তারা বলছিলেন, ‘একনায়ক নিপাত যাক।’
নিরাপত্তা বাহিনী ধারণা করেছিল, নিকা বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই তাকে টার্গেট করা হয়। কিন্তু সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয় নিকা। এরপর সে এক আত্মীয়কে কল করে গ্রেপ্তার চেষ্টার বিষয়টি জানায়। এর এক ঘণ্টার মধ্যে নিকাকে নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ দল ‘টিম টুয়েলভ’ গ্রেপ্তার করে। কিন্তু বিষয়টি তারা গোপন রাখে।
যেভাবে হত্যা করা হয় নিকাকে
গ্রেপ্তারের পর নিকাকে একটি ফ্রিজার ভ্যানে তোলা হয়। ভ্যানটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো লোগো ছিল না। সামনের কেবিনে ছিলেন কমান্ডার। পেছনে হাত বাঁধা নিকার সঙ্গে ছিলেন তিন সদস্য। ফ্রিজার ভ্যানটি ছিল অন্ধকার।
নিকাকে সেই ভ্যানে শুইয়ে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ভয়ংকর এ অবস্থাতেও নিকা অনবরত স্লোগান দিচ্ছিল। এ সময় তার পাশে বসা এক সদস্য যৌন নির্যাতন শুরু করেন।
হাত বাঁধা সত্ত্বেও নিকা বাধা দেন। তাকে সরিয়ে দিতে প্রবল চেষ্টা করেন। হয়তো ওই সদস্যকে লাথিও দেন নিকা।
এরপর বাকি দুজনও এ ঘৃণ্য কাজে যোগ দেন। কিন্তু নিকার বাধায় ক্ষিপ্ত হয়ে মারধর করে হত্যা করেন তারা।
বিবিসি দাবি করেছে, শুধু ফাঁস হওয়া নথির সারাংশ তারা প্রকাশ করেনি বরং নিজস্ব সূত্রের সাহায্যে বিশদ অনুসন্ধানের পর তা প্রকাশ্যে এনেছে।
বিক্ষোভকারী নিকা শাকারামির নিখোঁজ হওয়া এবং তার মৃত্যুর খবরটি ইরানে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। ইরানে নিজেদের স্বাধীনতা চেয়ে আন্দোলনরত নারীদের কাছে নিকা শাকারামির ছবিটি লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।
দ্য উইমেন, লাইফ, ফ্রিডম মুভমেন্ট নামের এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল মূলত ২২ বছর বয়সী তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে।
জাতিসংঘের একটি সত্য অনুসন্ধান মিশনের তদন্তে দেখা গেছে, পুলিশি হেফাজতে আঘাতের কারণে মাসা মারা যান। যথাযথভাবে হিজাব না পরার অভিযোগে তাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। এবার নিকার মৃত্যুর ঘটনা ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর আরও একটি ঘৃণ্য কাজ সামনে আনল।