মোদের দেশে বয়কট খুবই পরিচিত একটি শব্দ। যেকোনো কিছুতেই এই শব্দটি আমরা ব্যবহার করি বা করতে চাই। ইদানীং এর ব্যবহারে আমরা আরও সিদ্ধহস্ত হয়েছি বেশ। বয়কটের তালিকা দীর্ঘ করতে করতে অবস্থা এমন হয়েছে যে, এই আকাশ, এই বাতাস, সর্বোপরি পুরো দুনিয়াটাই সেই তালিকায় নাম লেখাতে পারে। কেবলই আমাদের হুজুগের আগুনে একটু ঘি বা কয়েক ছটাক ডিজেল–পেট্রোল পড়লেই হয়!
বয়কট একটি ইংরেজি শব্দ। এটি মূলত ক্রিয়া। এর অর্থ হলো এমন এক কর্মপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া, যার মধ্য দিয়ে কোনো কিছুর প্রতি (সেটি সামাজিক বা বস্তুগত বা অবস্তুগত—যাই হোক না কেন) অনাস্থা বা তীব্র নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করা। বাংলায় বলতে গেলে এক কথায় বয়কট হলো, ‘বর্জন’। অর্থাৎ, কোনো কিছু বর্জনের বা এড়িয়ে চলার বা প্রত্যাখান করার ডাক দেওয়া বা তাতে অংশ নেওয়াই হলো বয়কট।
এই যেমন ধরুন, হঠাৎ করে রব উঠল যে, এক চিল এসে আপনার কান নিয়ে গেছে! সাথে সাথে আপনার কান না থাকায় কী হলো বা কী হবে, সেসব আমরা চিন্তা করবই না একেবারে। কারণ, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ মূল কাজটি হলো, সরাসরি চিলকে বয়কটের ঘোষণা দেওয়া। দেখুন, চিলের কাছে আপনার কান আছে—তা তো কানে–মুখে বা গুজব হিসেবে শোনাই গেল। এর সত্যাসত্য যাচাই করার কোনো মানেই হয় না। বরং সরাসরি আকাশে ওড়া চিলের বিরুদ্ধে বয়কট কর্মসূচির ডাক দিয়ে দেওয়া ভালো। প্রয়োজনে আকাশে চিলের পাখা মেলে ওড়ার বিষয়েই বয়কট দিয়ে দেওয়া যায়। আর অবশ্যই সেই বয়কটের ডাক দিতে হবে ফেসবুকে। চিলের বিরুদ্ধে এই বয়কট কর্মসূচি সফল করার বিষয়টি যেহেতু মার্ক জাকারবার্গই দেখভাল করবেন, সেহেতু সেখানেই তো বর্জনের ডাক দিতে হবে, নাকি? হাজার হোক চিল তো ফেসবুকের নীল আকাশেই ওড়ে!
জাকারবার্গের ফেসবুকে এমন অনেক ইস্যুই ওড়ে। সেসব ইস্যু নিয়ে দুদিন পরপরই এই বঙ্গদেশের অধিবাসীরা সরব হয়ে ওঠে। আর বিভিন্ন শ্লেষাত্মক আলোচনার পর তারা বিদ্রোহী ও বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। আদতে তো আমরা বীরের জাত। প্রতিবাদী রক্ত আমাদের শিরায় শিরায় বহমান। তাই প্রতিবাদ আমাদের করতেই হবে। নইলে যে প্রকৃতি আমাদের ক্ষমা করবে না! আর এ কারণেই শেষতক আমরা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ভালোমতো বমি করে উগড়ে দেওয়ার পর নজর দিই সেই ভয়ানক অস্ত্রের দিকে। দিয়ে দিই বয়কটের ডাক। এরপরে আর মোদের পায় কে!
দেখা গেল, বর্ষায় বৃষ্টির পানি জমে গেল রাস্তায়। প্রয়োজনে আমরা রাস্তাকেই বয়কট করতে পারি। অথবা চাইলে বৃষ্টিকেও বয়কট করে ফেলা যায়। সবচেয়ে ভালো হয় পুরো আকাশটাকেই বয়কট করে দিলে। ওখান থেকেই যে বৃষ্টি ঝরে!
তেমনি শীতের দিনে কোনো কারণে দখিনা বাতাস বইলে আমরা বাতাসও বয়কট করে দিতে পারি। একটি কথা বলে রাখি, এই দেশের মানুষ যদি বাতাস বয়কট করেই ফেলে, তবে কিন্তু বাতাস পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। এ দেশের মানুষের বয়কটের জোর এতখানিই।
এই উপমহাদেশে ‘হাঙ্গার স্ট্রাইক’ বা অনশনের চল আছে বেশ। এ নিয়ে অবশ্য নানা রঙ্গ–রসিকতাও চালু আছে। যেমন: অসৎ মনোবৃত্তির মানুষের হাঙ্গার স্ট্রাইক বিভিন্ন সময় নানা নাটক–সিনেমায় এমন দৃশ্যও দেখানো হয়েছে যে—সবার সামনে চলছে অনশন, আর পেছনে চলছে গলাধঃকরণ। বর্তমানে এ দেশে চালু হওয়া বয়কট সংস্কৃতিরও প্রকৃতি অনেকটা তেমনই। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ফেসবুক বয়কটের ডাকও এ অঞ্চলের কথিত ‘পতিবাদী’ মানুষেরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েই দেয়! তাতে আবার হাজার হাজার মানুষ লাভ রিঅ্যাক্টও দেয়। এবং এভাবেই বয়কট আন্দোলন দিনকে দিন স্ট্রং হতে থাকে। এসব দেখে মার্ক জাকারবার্গ মনে মনে হাসতে হাসতে এভারেস্টের চূড়া থেকে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতি নেন কিনা, কে জানে!
তবে এসবের মধ্যে কিন্তু ইতিবাচক বিষয়ও আছে। ধরুন, আমাদের বয়কট সংক্রান্ত যে অতুলনীয় মেধা, তা দিয়ে অচিরেই বয়কট এজেন্সি খুলে ব্যবসা করা যায়। বিশ্বের দেশে দেশে সব মনুষ্যসন্তানকে বয়কটের ধারণা রপ্তানি করতে পারি মোরা। রপ্তানি করা যায় কী বয়কট করা যায়, কীভাবে করা যায়—সেই সংক্রান্ত ধারণাও। এতে করে ডলারও আয় করা যাবে। এরপর ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে নিজেদের পরিচয়ও দিতে পারবেন বাংলাদেশের বয়কট বোদ্ধারা!
আইডিয়াটা খারাপ না। ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। আসুন, আমরা ভাবি, ভাবা প্র্যাকটিস করি। মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধ ব্যবহারেই যেখানে বয়কটের এত বিষয় পাওয়া যাচ্ছে, এর সঠিক ব্যবহারে মাথা নিশ্চয়ই আরও খুলবে। ঘুরেও যেতে পারে। ক্ষতি কী! এভাবেই হয়তো আমরা পুরো দুনিয়া বয়কট করার পদ্ধতিও একদিন আবিষ্কার করে ফেলব। সেদিন পুরো পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে মোদের দিকেই তাকিয়ে রবে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলতে পারে। এমন প্রতিভার আলো দুই চোখে দেখে সহ্য করাও তো কঠিন!
যেভাবে আমরা এগোচ্ছি, সেদিন খুব বেশি দূরে নয়। অন্ধকার টানেলের অন্য প্রান্তে এমন প্রতিভার সূর্য দেখা দেবে নিশ্চিত। ততদিন পর্যন্ত না হয় অপেক্ষায় থাকি। দেখা হবে বয়কটে!