“আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ঈদের উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। এসব উপহার দেখলে কান্নায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। ছেলেটা সামনে থাকলে এখন কান্নাও করতে পারি না।”
একবছর স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে দুই সন্তানের কাছে তাহমিনা বেগম শবনমই ছিলেন বাবা-মা। এবার মেয়ে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকাকে কথাও দিয়েছিলেন ঈদের জামা কিনে দিবেন। কিন্তু মেয়ে নেই, এটা ভাবতেই বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে তার। ঈদ আনন্দের যে অনুভূতি, মেয়ে না থাকায় সেটাই হারিয়ে ফেলেছেন শবনম।
পরপর দুই বছরে দুই কাছের মানুষের মৃত্যু তাহমিনাকে যেন মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। গত বছর রোজায় স্বামী অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিনের মৃত্যু মাটি করে দেয় পরিবারটির ঈদের আনন্দ।
আর এক বছরের ব্যবধানে সেই রোজার মাসেই একমাত্র মেয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে যেন জীবনের সব আনন্দই শুষে নিয়ে যান।
সোমবার অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগম শবনম বলেন, “গত বছরের ২২ রমজানে অবন্তিকার বাবার মৃত্যুর পর রাত ৩টায় আমরা মরদেহ নিয়ে কুমিল্লায় আসি। পুরো রাস্তায়ই আমরা কেউ অবন্তিকার কান্না থামাতে পারিনি। সেই বছরের ঈদ আমাদের পরিবারের জন্য ছিল একটি বড় দুর্যোগ।
“এবার রমজান শুরুর আগেই অবন্তিকাকে কথা দিয়ে ছিলাম ঈদে কুমিল্লা আসার পর তাকে পছন্দের জামা-কাপড় কিনে দেব। ভাবতাম আমিই সন্তানদের বাবা-মা। কিন্তু মেয়েটাকে আর ঈদের জামা কিনে দিতে পারলাম না। এর আগেই সব তছনছ হয়ে গেল। অবন্তিকা কবরে, তাকে ছাড়া আমাদের কিসের ঈদ?”
‘অবন্তিকা কবরে, তাকে ছাড়া কিসের ঈদ’
মেয়েকে নিয়ে ঈদের স্মৃতি বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তাহমিনা বেগম। জানালেন, ছোটবেলা থেকেই ঈদ কাছে আসলে মেয়ে বাবার ছুটির অপেক্ষায় থাকত।
অবন্তিকার বাবা কলেজ শিক্ষক ছিলেন, তাই তার বেতন-বোনাসের উপরই চলত সংসার। বেতন-বোনাস হাতে আসলে চারজনে মিলে যেতেন মার্কেটে।
“বাবা শিক্ষক, তাই অবন্তিকা, তার ছোট ভাই জারিফ জাওয়াদ অপূর্বের চাহিদা তেমন ছিল না, আমরা চাইলেও অবন্তিকা দামি জামা নিতে রাজি হতো না। দামি জুতা দিতে চাইলে অর্ধেক দামে জুতা কিনেই খুশি থাকত।”
বোন না থাকায় এসএসসির ফলের অপেক্ষায় থাকা জারিফের মনও ভয়াবহ খারাপ বলে জানান তাহমিনা।
তিনি বলেন, “আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ঈদের উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। এসব উপহার দেখলে কান্নায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। ছেলেটা সামনে থাকলে এখন কান্নাও করতে পারি না।”
অবন্তিকা ভালো চাইনিজ খাবার রান্না করতে পারতনে জানিয়ে তাহমিনা বলেন, “বাসায় ঈদের সময়ে বিভিন্ন সেমাই রান্নার করত সে। আমার সেই মেয়েটা এখন নেই, ভাবতেই কষ্ট হয়।”
“অবন্তিকা পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। কিন্তু কিছু ছাত্রের উৎপীড়ন ও জবি প্রশাসন থেকে বিচার না পেয়ে অকালে মেয়েটাকে জীবন দিতে হলো। আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে আত্মহুতি দিল মেয়েটা। এসবের জন্য জবি প্রশাসনই দায়ি। তারা এখন যেভাবে তৎপর এভাবে আগে তৎপর হলে মেয়েটাকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। আমি দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।”
‘অবন্তিকা কবরে, তাকে ছাড়া কিসের ঈদ’
গত ১৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা নগরীর বাগিচাগাঁও ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন অবন্তিকার। তার আগে ফেইসবুক পোস্টে আত্মহত্যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও আম্মান সিদ্দিকী নামের এক সহপাঠীকে দায়ী করেন তিনি।
এ ঘটনায় ১৬ মার্চ রাতে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগম শবনম সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম ব্যাচের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামি বর্তমানে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
অবন্তিকার মৃত্যুর পরদিন ১৬ মার্চ জবির শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু তিন সপ্তাহ পার হলেও এখনো তদন্ত শেষ করতে পারেনি দলটি।
তদন্ত দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, ঈদের পর বিশ্ববিদ্যালয় খুললে দ্রুততম সময়ে তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করবেন।