ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগে চলমান আন্দোলনে একটি “অন্ধকার সংগঠনের” ইন্ধন দেখছেন প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ শিক্ষার্থী। তাদের অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে একটি অন্ধকার সংগঠনের ইন্ধনে বুয়েটে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। বুয়েটে কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসলামী ছাত্রশিবির ও নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীর।
শনিবার (৩০ মার্চ) বিকেল ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই অভিযোগ করেন। সংবাদ সন্মেলনে অংশ নেওয়া পাঁচ বুয়েট ছাত্র নিজেদের “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ছেলে” হিসেবে দাবি করেছেন।
তারা বলছেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হয়ে যিনিই কথা বলছেন, তাকেই ‘ছাত্রলীগ’ ট্যাগ দিয়ে বারবার অত্যাচার করা হচ্ছে।”
আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পরও বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালায়। এ ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়ে পাঁচ দফা দাবিতে টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা বর্জন করে শনিবার দ্বিতীয় দিনের মতো ক্যাম্পাসে সকাল ৭টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন কয়েক’শ শিক্ষার্থী।
এমন প্রেক্ষাপটে বেলা তিনটার পর ওই পাঁচ ছাত্র বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান তানভীর মাহমুদ। তিনি দাবি করেন, তারা পাঁচজন কোনো ছাত্রসংগঠনের পদধারী নন।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “২০২৩ সালের জুলাইয়ে সুনামগঞ্জের হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতার অভিযোগে বুয়েটের প্রাক্তন এবং বর্তমান ৩৪ জন শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হন। তাদের নামে এখনো আদালতে মামলা চলমান এবং সবাই জামিনে আছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কয়েকজন সাধারণ শিক্ষার্থী মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করি। এই মানববন্ধন করার পর আমাদের চিহ্নিত করে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং জবাবদিহি চাওয়া হয়। বিভিন্ন হলের কক্ষে কক্ষে রাত ১১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ডেকে জবাবদিহি চাওয়া হয়। এমনকি মানববন্ধনকে একটি অপরাধের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের হল থেকে বের করে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়।”
তানভীর মাহমুদ বলেন, “বুয়েটের অভ্যন্তরীণ ফেসবুক গ্রুপগুলোতে আমাদের পক্ষে কেউ নিজের কোনো মতামত রাখতে গেলে তাকে বুলিং এবং নানা ধরনের হুমকির শিকার হতে হয়। আমাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক কিংবা পরিচয় থাকায় অনেককেই কটাক্ষের স্বীকার হতে হয়। যে কারোরই পারিবারিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি বা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেই বা পরিচয় থাকলে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়; পরিবার নিয়েও অশালীন মন্তব্য করা হয় অনলাইন ও অফলাইনে।”
তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের মতো গুটিকয়েক ছেলের বিরুদ্ধে কারা এবং কাদের ইন্ধনে এসব হচ্ছে, তা একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে। মিথ্যাচার করে আমাদের দোষী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠী।”
সংবাদ সম্মেলনে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রমের বিষয়ে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন আরেক বুয়েট ছাত্র আশিক আলম৷ তিনি বলেন, “বুয়েটর সংবিধানে ক্যাম্পাসে সব ধরনের ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের যে আইন আছে আমরা তাকে সম্মান করি। তবে এই সুযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে গোপনে হিজবুত তাহরির, ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো নিষিদ্ধ সংগঠনগুলো কাজ করছে। আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনায় আমরাও দুঃখিত। তবে সে ঘটনার আবেগকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে।”
আশিক আলম বলেন, “একবার আমরা বন্ধুবান্ধব ও সিনিয়র-জুনিয়র মিলে ক্যাফেটেরিয়ায় কাচ্চি রান্না করে খাই। এটিকে রাজনৈতিক তকমা দিয়ে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সব ধরনের গ্রুপ ও ক্লাব থেকে বের করে দেওয়া হয় আমাদের। শিক্ষা উপকরণ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ভালো খেলা সত্ত্বেও সব ধরনের খেল থেকে বাদ দেওয়া হয়। আমাদের র্যাগার, খুনি, মাদকাসক্তসহ আরও অপবাদ দেওয়া হয়।”
ছাত্ররাজনীতিমুক্ত বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের দমিয়ে রেখে অন্ধকার রাজনীতি শিক্ষার্থীদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন আশিক। তিনি বলেন, “আমরা সুষ্ঠুভাবে ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করতে চাই, পরীক্ষা দিতে চাই। সবাই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মতাদর্শে বিশ্বাস করুক। তবে স্বাধীনতাবিরোধী কোনো চেতনাকে আমরা কখনোই বুয়েটে ঠাঁই পেতে দেব না।”
২০১৯ সালের অক্টোবরে আবরার ফাহাদ হত্যার পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। তবে গত বছর বুয়েট শিক্ষার্থীদের পদ দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলে বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা তৈরি হয়। তখন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পুরোনো বিজ্ঞপ্তিটি আবার ওয়েবসাইটে প্রচার করা হয়।