এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যাংকিং খাতে এ মুহূর্তে আলোচনার শীর্ষে পদ্মা ব্যাংক। যদিও ফারমার্স ব্যাংক নামে কার্যক্রম শুরুর পর কখনোই আলোচনার বাইরে ছিল না এই প্রতিষ্ঠান। তবে সব আলোচনা-সমালোচনার অবসান ঘটিয়ে অচিরেই এক্সিম ব্যাংকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। এতসব ঘনঘটার মধ্যে আড়ালে রয়ে যাচ্ছেন ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০১৩ সালে অনুমোদন পায় ফারমার্স ব্যাংক। এই অনুমোদনের পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনিই ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। উদ্যোক্তাদের মধ্যে তিনিই সব মহলে পরিচিত মুখ।
তবে নজিরবিহীন ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠার চার বছর না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যাংকটি। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। আমানতকারীদের বেশিরভাগ টাকা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দীন খান আলমগীর এবং নিরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর পকেটে ঢুকেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে। এ পরিস্থিতিতে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন। ব্যাংকটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীমকেও অপসারণ করা হয়।
তখন এই ব্যাংককে বাঁচাতে মূলধন সহায়তা দেয় সরকারি চার ব্যাংক ও আইসিবি। সেই সুবাদে ব্যাংকটির পরিচালনায় যুক্ত হন ওই চার ব্যাংক ও আইসিবির প্রতিনিধিরা। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে দ্য ফারমার্স ব্যাংকের নাম বদলে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক।
ওই ঘটনায় শুধু ফারমার্স (পরিবর্তিত নাম পদ্মা ব্যাংক) নয়, এর প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দীন খান আলমগীরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও ধসে যায়। সারা জীবন আলোচনা-সমালোচনায় থাকা সাবেক এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামটিই ধীরে ধীরে অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। তিনি এখন আর নেই কোনো খবরে। ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছাড়ার সময় মহিউদ্দীন খান আলমগীর ছিলেন সংসদ সদস্য। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং জয়ী হন। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর পাননি দলীয় টিকিট। এক সময় তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। এখনো আছেন উপদেষ্টা পরিষদে। তবে রাজনীতিতেও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে নীরবে-নিভৃতে নিজ ব্যবসা ও লেখালেখিতে মনোযোগ দিয়েছেন সাবেক এই দাপুটে আমলা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে স্ত্রী সন্তানের সঙ্গে আমেরিকায় অবস্থান করছেন ম খা আলমগীর। দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশায় জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশে ছিলেন। নির্বাচনের পর আবার বিদেশে পাড়ি জমান সাবেক এই মন্ত্রী।
ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য থাকলেও তিনি আর কোনো পর্যায়েই রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। অবসর সময় কাটাচ্ছেন বই লিখে। গত অমর একুশে বই মেলায় এ ‘যা দেখেছি, যা শুনেছি’ নামে একটি বই বের করেছেন। এ ছাড়া নিজের শিপিং ব্যবসা, ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি মেডিকেল কলেজের দেখভাল করেন, দুটি প্রতিষ্ঠানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানও তিনি।
যোগাযোগ করা হলে মহিউদ্দীন খান আলমগীরের ব্যক্তিগত সহকারী রাজীব আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘বড় ছেলে জালাল আলমগীরের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি গত ১৮ মার্চ আমেরিকায় গেছেন। সেখানে পরিবারের সদস্যরা থাকেন। ঈদের পর তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি এখনো আগের মতোই এলাকার মানুষকে সময় দেন। শিপিং ব্যবসা, ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও সিটি মেডিকেল কলেজের দেখভালও করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে নানান অপপ্রচার চালানো হলেও সেগুলো সত্য নয়।’
বিভিন্ন সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে কর্মরত ছিলেন মহিউদ্দীন খান আলমগীর। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আমলা হিসেবে সরকারি চাকরিরত অবস্থায় তিনি আবারও আলোচনায় আসেন। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে যখন বিএনপির বেহাল দশা, সেই কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছিলেন এই ম খা আলমগীরের নেতৃত্বে জনতার মঞ্চে যোগ দেওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের মিছিল। সেই থেকে আওয়ামী লীগের সুনজরে আসেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব করা হয়। পরে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৯৭ সালে তাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেসময় তিনি পর্যায়ক্রমে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে না পারলেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। ওয়ান-ইলেভেনে সেনা সমর্থিত সরকারের সময় তিনি জেল খাটেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ২০১২ সালে। এক বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান। তার সময়কালেই ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা। সেসময় তার উক্তি ‘হরতালকারীদের ধাক্কাধাক্কিতে রানা প্লাজা ধসে পড়েছে’, ব্যাপক সমালোচিত হয়।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও বিদেশে অবস্থানরত মহিউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তার পাঁচটি মোবাইল নম্বরে কল করেও পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।