তামিম ইকবালের জন্মদিন ছিল বুধবার। তার হাত ধরে এসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক স্মরণীয় জয়। দেশের ক্রিকেটে অনেকগুলো রেকর্ডের মালিক এখনো তিনি।
জন্মদিনে তামিম ইকবালের ভেসে যায় ভক্তদের শুভেচ্ছা বার্তায়। কিন্তু তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা লেখা হয়েছে তার সবই শুভেচ্ছাময় ছিল না।
ভালবাসায় ভাসিয়ে দেওয়ার বদলে বেশির ভাগ মানুষই সমালোচনায় ডুবিয়েছেন এই ওপেনার। একটি সংস্থার বিজ্ঞাপণি প্রচারে অংশ নিতে গিয়ে নিজেকে তিনি খুবই সস্তা বানিয়ে ফেলেছেন কিনা সেই আলোচনাও হয়েছে। বিশ্বকাপের আগে থেকেই জাতীয় দল থেকে তার ছিটকে পড়া ও ফিরে আসার পথ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাওয়ার জন্য আকারে ইঙ্গিতে তামিম অনেকবার অন্যদের দায়ী করেছেন। কিন্তু এবার যে সমালোচনার মুখে তিনি পড়েছেন, তাতে অন্য কাউকে দায়ী করার সুযোগ তিনি একেবারেই পাচ্ছেন না। মোবাইল ফাইনান্সিং কোম্পানি নগদের হয়ে বিতর্কিত এই প্রচার কাজে যে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফেসবুক লাইভে এসে নিজেই আবার এটাকে বলেছেন, নাটক।
ঘটনার সূত্রপাত যদিও একদিন আগে। বাংলাদেশে একটি টিভি চ্যানলের খেলাযোগ বিভাগ ফাঁস করে বসলো তামিম আর মেহেদী হাসান মিরাজের টেলিফোন সংলাপ। রীতিমতো প্রাইম টাইম বুলেটিনে এটা প্রচার করা হলো সংবাদ হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো দেওয়া হলোই। কণ্ঠস্বর, বাচন ভংগি কোনো কিছু নিয়ে সন্দেহ করার সামান্যতম অবকাশও ছিল না। ফাঁস হওয়া এই সংলাপে তামিমের সঙ্গে মুশফিকুর রহিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটার আলামত স্পষ্ট। মুশফিক তাকে বাদ দিয়ে কোনো এক নতুন দল গড়ছেন তা নিয়ে তামিমের যত উষ্মা। নড়েচড়ে বসল দেশের ক্রিকেট প্রেমীরা।
এমনিতে সাকিব-তামিমের সম্পর্কের অবনতি ঘটায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। এখন মুশফিকও যদি তাদের এই শীতল যুদ্ধে যোগ দেন সেটা হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য আরেক অশনি সংকেত। চারদিকে তাই শুরু হয়ে যায় উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। কিন্তু রাতে যা ছিল উদ্বেগ সকাল নামতেই সেটা বিরক্তিতে রূপ নেয়। কারণ, ঘটনা ততক্ষণে অনেকেই জেনে গেছেন।
তামিম-মিরাজের এই সংলাপ, যাকে পরে অনেকেই প্রলাপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, তা আসলে ছিল সাজানো। মোবাইল ব্যাংক নগদের বিজ্ঞাপনী প্রচারণার অংশ। টেলিভিশনের দর্শকরা এতে প্রতারিত বোধ করেছেন। তামিম, মিরাজের ভক্তরা হয়েছেন হতাশায়, বিষ্ময়ে বিমূঢ়। অল্প কিছু নগদ নারায়ণের বিনিময়ে তাদের প্রিয় ক্রিকেটাররা নগদের হয়ে এধরণের ভুয়া টেলিফোন সংলাপের নাটক সাজাতে পারেন এটা ছিল অনেকের কাছেই ছিল ভাবনার অতীত।
ঘটনা চাউর হতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঢেউ উঠে। তামিম বলেছিলেন, সন্ধ্যায় ফেসবুক লাইভে আসবেন। তাতে কেউ কেউ আশাবাদী হয়েছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু কিসের কি। লাইভে তিনি ঠিকই এসেছেন। সঙ্গে মিরাজকে তো এনেছেনই,
মুশফিক আর মাহমুদুল্লাহকেও ডেকে এনে একসঙ্গে গায়ে কালি মেখেছেন। সিংহভাগ ক্রিকেটপ্রেমীর প্রতিক্রিয়া অন্তত তেমনই।
তামিম-মিরাজদের এই ভুয়া টেলিফোন সংলাপ নাটকে সংবাদ প্রচার ও পণ্য বিপণনে বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতার মান নিয়ে ও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। একটি সংবাদ মাধ্যম কোনো ধরনের ডিসক্লেইমার না দিয়ে জেনে শুনে সাজানো কিছু খবর হিসেবে প্রচার করতে পারে কি-না সেই প্রশ্নতো উঠেছেই, একই সংগে এটাও আলোচনায় এসেছে যে, পণ্য বিপণনের কাজে কেউ জাতীয় কোনো আবেগ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারে কিনা?
স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ের, সাংবাদিকতা, যোগাযোগ ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান, সহযোগী অধ্যাপক মো. সামসুল ইসলাম দুটি বিষয়ের কোনোটিকেই সমর্থন করতে পারেননি। সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবেই নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেও বলতে পারি এটা সাংবাদিকতার নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সাংবাদিকতা এবং বিজ্ঞাপন, তাদের একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে, এবং যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা এই সীমা রেখার একটা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন আমরা বলতে পারি। এটা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। শুধু সাংবাদিকতা নয়, বিপণন কৌশল হিসেবেও এথিক্যালি এটা ঠিক নয়।
ক্রিকেটারদের প্রত্যেককে তিনি মনে করেন একজন কালচারাল আইকন। একজন ক্রিকেটার কোনো ভাবেই এধরণের ক্যাম্পেইনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনন না এমন অভিমত জানিয়ে তিনি বলেছেন, এধরণের আচরণ সাধারণ জনগণের সাথে একরকম প্রতারণা।” নগদকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তিনি বলেছেন, “তাদের এই বিপণন কৌশল দেশের জনগণ ভালভাবে নেয় নাই।”
সিনিয়র ক্রীড়া সাংবাদিক এম এম কায়সারের কাছেও পুরো বিষয়টা মনে হয়েছে খুবই সস্তা কাজ। সংবাদ সম্প্রচার ও পণ্য বিপণনে নীতি নৈতিকতার বড় ধরণের বিচ্যুতি যে এখানে ঘটেছে সে বিষয়ে তিনিও একমত। পাশাপাশি, এই ঘটনার পর যে ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে সেই আশঙ্কাও তিনি ব্যক্ত করেছেন। পাতানো টেলিফোন সংলাপে তামিম যেভাবে মিরাজকে বলেছেন, আমি ক্যাপ্টেন থাকলেতো এভাবে করতে পারতিনা, সেই প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, “ক্যাপ্টেন হলেই যে তাকে নম নম করতে হবে ,তার আশে পাশে থাকতে হবে, তাকে তেল দিতে হবে, এধরনের কথায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।”
এমনিতেই স্পট ফিক্সিং বিতর্কের পর খেলোয়াড়দের অনেক পারফরমেন্সকেই সাধারণ মানুষ আজকাল সন্দেহের চোখে দেখে। এই ঘটনার পর কোনো ক্রিকেটার সত্য বললেও মানুষ বিশ্বাস করবে কি-না সেই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, এখন কোনো ক্রিকেটার যদি কেঁদেকেটেও স্ট্যটাস দেন, আমার মা মারা গেছেন সেটাও লোকজন প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইবে না, ভাববে এটাও বোধ হয় কোনো ক্যাম্পেইনের অংশ।
ক্ষতি যা হয়েছে তা কেবল ক্রিকেটেরই। অনলাইন অ্যকিস্টভিস্ট আরিফ জেবতিক নিজের ফেসবুক পেইজে লিখেছে, দুইদিন বাদে যদি কেউ খবর প্রকাশ করে যে, অমুক ক্রিকেটার মারা গেছে, আপনারা জানাজায় আসুন। তাহলে অনেক লোকই সেই লাশকে খোঁচা দিয়ে দেখবে যে আদৌ মারা গেছে নাকি নগদের বিজ্ঞাপণ করতেছে।
বুধবার তামিমের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভ শেষ হওয়ার পরই একটি সংবাদমাধ্যম এ ব্যাপারে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছিল। স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে বোর্ড সভাপতি বলেছেন, ‘এসব ফাজলামি…আমি কী বলব? ব্যাপারটা দেখছি আমি।’