Friday, November 22, 2024

এবার হল না, দেখা হবে নতুন ঈদে: জিম্মি নাবিক আতিক উল্লাহ

আরও পড়ুন

অডিও বার্তায় তিনি বলেন, “ভালো থাকুক প্রিয়জন, ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ। ঈদ মোবারক বাংলাদেশ।”

প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে পরিবারের সদস্য এবং স্বজনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে চেয়েছিলেন সোমালি জলদস্যুর হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক আতিক উল্লাহ খান, তবে তার ইচ্ছা এবার পূরণ হল না।

সোমালিয়া উপকূলে জিম্মিদশায় থাকা জাহাজটির চিফ অফিসার আতিক বুধবার জাহাজের ডেকে ঈদের নামাজ পড়ার পর বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠানো এক ভয়েস রেকর্ডে ওই আকুতি জানান।

সেখানে আতিক বলেন, ঈদের আগেই জিম্মিদশা থেকে মুক্তি মিলবে বলে তিনি আশা করেছিলেন মনেপ্রাণে; তার আশা ছিল, মুক্তির পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারবেন।

কিন্তু বাস্তবতা মেনে নিয়ে ভবিষ্যতে দ্রুত সময়ে মুক্তি মিলবে এমন আশাবাদ রেখে পরিবার ও স্বজনদের সাথে নতুন ঈদে মিলিত হওয়ার প্রত্যাশা জানিয়েছেন এই নাবিক।

আতিকের ছোটভাই আবদুল নুর খান আসিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জিম্মি নাবিকেরা বুধবার জাহাজেই ঈদের নামাজ পড়েছেন। এরপর ভাইয়া আমাদের একটি ভয়েস রেকর্ড পাঠিয়েছেন। তাতে ঈদের শুভেচ্ছা জাননোর সাথে তাদের জিম্মিদশার কথা জানিয়ে দোয়া করতে বলেছেন।”

গত ১২ মার্চ দুপুরে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের কবির গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল জাহাজটি। জিম্মি ২৩ নাবিকের সবাই বাংলাদেশি।

অস্ত্রের মুখে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর জলদস্যুরা তাদের সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যায়। সেখানে পৌঁছানোর পর বার বার জাহাজের অবস্থান পরিবর্তন করা হয়। ছিনতাইয়ের নয় দিনের মাথায় জলদস্যুদের সাথে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ হয় জাহাজের মালিকপক্ষের।

আরও পড়ুনঃ  এক রঙের পাঞ্জাবিতে ঈদের মাঠে ২০০ মুসল্লি

মালিকপক্ষের সাথে জলদস্যুদের নিয়মিত আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি চলছে জিম্মি নাবিক ও জাহাজের মুক্তির জন্য। সময় না বললেও দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের মুক্ত করার প্রত্যাশা জানিয়ে আসছে মালিকপক্ষ। সেই আশায় বুক বেঁধেছেন জিম্মি নাবিকদের পরিবারের সদস্যরাও।

বিশ্বের অনেক দেশের সাথে মিল রেখে বুধবার সোমালিয়াতেও ঈদ উদযাপিত হয়েছে। জিম্মি নাবিকরা জাহাজেই ঈদের নামাজ পড়েছেন, একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।

ভয়েস রেকর্ডে আতিক উল্লাহ খান বলেন, “হাদিসে আমরা শুনেছি, মজলুম ও মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ পাক কবুল করেন। তাই মনে প্রাণে দোয়া করছিলাম এবারের ঈদটা যেন বাসায় করতে পারি। কারণ এবার আমাদের সাথে ঈদ করার জন্য মুখিয়ে আছে পরিবার পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবসহ একরাশ শুভাকাঙ্ক্ষী।”

যদিও দস্যুর কবলে না পড়লে আতিকদের এবার ঈদ করার কথা ছিল সমুদ্রেই। কিন্তু বন্দিদশা বদলে দিয়েছে বাস্তবতা, তাদের হৃদয়জুড়ে এখন দেশে ফেরার আকুতি।

আতিক বলেন, “একসাথে এতগুলো প্রিয়মুখ দেখার লোভটা সামলে নিতে হচ্ছে। কারণ ঈদের আগে সোমালিয়ার জলদস্যুদের জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। মনকে আমরা আরেকবার শক্ত করলাম। কারণ এখন পরিস্থিতিই তো নিজেকে সামলে নেবার। নিজেকে মানিয়ে নিতে হচ্ছে এ জিম্মিদশার সাথে…।”

তিনি বলেন, “মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে আল্লাহ রব্বুল আলামীন এ জিম্মিদশার মধ্যেও সুন্দরভাবে সুস্থভাবে রোজা ও তারাবি নামাজ করার তৌফিক দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ, এটা আল্লাহর একটা রহমত।”

আরও পড়ুনঃ  পরিবারের কাছে ফিরলেন সোনালী ব্যাংকের অপহৃত সেই ম্যানেজার

এমভি আবদুল্লাহর ক্যপ্টেন আবদুর রশিদের পরিচালনা এবং নাবিকদের ধৈর্য ও সুন্দর মনমানসিকতার ফলে শুরু থেকেই সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে একটি ‘ভালো বোঝাপড়া’ তৈরি হয়েছে বলে জানান আতিক।

তিনি বলেন, “একবার জিম্মি হয়ে গেলে তাদের সাথে সহযোগিতা করা ছাড়া আর কিছু করতে যাওয়া এক ধরনের বোকামি।”

আতিক উল্লাহ তার পরিবারের কাছে পাঠানো অডিও রেকর্ডে বলেন, “শুরুতে জলদস্যুরা কঠোর আচরণ করলেও পরে তারা আমাদের নামাজ, রোজাসহ বিভিন্ন কাজে কিছুটা ছাড় দিত। ফলস্বরূপ দিনের বেলা কেবিনে এবং রাতের বেলায় সবাইকে ব্রিজে থাকার অনুমতি দেওয়া হল। সপ্তাহে একদিন স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করার অনুমতিও দিল।

“এর বাইরে দুম্বা এবং রসদ সাপ্লাইয়ের বিষয়টি ছিল কমন ব্যাপার। এটা সাধারণত সব জিম্মি জাহাজের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। পরিস্থিতির কারণে এখন আমরা সবাই যেমন দুম্বার মাংস খেতে অভ্যস্ত হয়েছি। তেমনি সপ্তাহে একদিন পানি ব্যবহারেও অভ্যস্ত হয়েছি।”

কবে মুক্ত হবেন, সেটা ভাবনায় নির্ঘুম রাত কাটানোর বিষয়টিও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে বলে জানান আতিক।

তিনি বলেন, “প্রায় সময় দস্যুদের টেস্ট ফায়ারিংয়ের শব্দে পুরো জাহাজ কেঁপে ওঠে। এটাও এখন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। গাদাগাদি করে ব্রিজের ফ্লোরে রাত কাটানোর অভ্যাসও আমাদের হয়ে গেছে। ইনশাল্লাহ সামনের দিনগুলোতে আমরা সারভাইভাল টেকনিক এপ্লাই করে পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করব।

আরও পড়ুনঃ  গতবারের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে তরমুজের বিক্রি

“পরিশেষে আমরা আশা করব, পুরো দেশবাসীর দোয়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় নৌমন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে এবং প্রিয় আবদুল্লাহ জাহাজের মালিকপক্ষ এসআর শিপিংয়ের আন্তরিক ও ত্বরিৎ প্রচেষ্টায় দস্যুদের সাথে মুক্তিপণের বিষয়ে একটি দফারফার মাধ্যমে দ্রুতই অবসান ঘটবে এ জিম্মিদশার।”

ঈদের পর প্রিয়জনদের সাথে প্রিয় মাতৃভূমিতে ‘আবার ঈদ হবে’– সেই আশা রেখে আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিক আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, “সে পর্যন্ত অবশ্যই আপনারা আমাদেরকে আপনাদের দোয়ায় রাখবেন। ভালো থাকুক প্রিয়জন, ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ। ঈদ মোবারক বাংলাদেশ।”

জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে জানতে চাইলে এমভি আবদুল্লাহর মালিক প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, “আমাদের আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা দ্রুত সময়ে নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি।”

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিনার্স অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমভি আবদুল্লাহর নাবিকরা জিম্মি দশায় না পড়লেও তারা এবারে রোজার ঈদে দেশে থাকার কথা না। যারা সমুদ্রগামী জাহাজে কাজ করেন, তারা প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে থাকেন।

“ঈদ বা কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ তাদের থাকে না। আবদুল্লাহর নাবিকদেরও সে সুযোগ এবার ছিল না। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচেষ্টার কারণে ঈদের আগে তাদের মুক্তির সম্ভাবনার বিষয়টি সামনে আসে।”

সোমালি দস্যুদের কবল থেকে জিম্মিদের উদ্ধারে কিছু প্রক্রিয়া সারতে হবে জানিয়ে আনাম চৌধুরী বলেন, “আবদুল্লাহর মালিকপক্ষ সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়। তবে সেজন্য সময়ের প্রয়োজন।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ